বন্ধ হোক ‘পিষে মারার সংস্কৃতি’

অন্যের মুখে শোনা বলে আপনি এর সত্যতা নিয়ে সন্দিহান হতে পারতেন, একে কম গুরুত্ব দিতে পারতেন, উত্তেজনার মুখে ‘কথার কথা’ বলেও আপনি খানিকটা হয়তো ভিন্নভাবে বিবেচনা করতে পারতেন; যদিও কথাটা কেবল কথা থাকেনি, বলতে না-বলতেই কাজে রূপান্তরিত হয়েছে। সর্বসমক্ষে নিহত হয়েছেন একজন, দিবালোকে। আসলে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনা কয়েক দিন আগের। ঢাকার উত্তরায় জসীমউদ্দীন রোডের মোড়ে একজন বাসচালকের সঙ্গে একজন অটোরিকশাচালকের বাদানুবাদ হয়, তারপরে বাসচালক আবদুল মজিদ (২৫) বাসটি তুলে দেন অটোরিকশাচালক মো. ফারুকের (৪০) ওপর। বাসের চাকায় পিষ্ট ফারুকের দেহ বাসটি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে অন্তত আধা কিলোমিটার। বাদানুবাদ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা বলেছেন, আবদুল মজিদ হুমকি দিয়েছিলেন, ‘তুই সর। নাইলে পিষ্যা ফালামু তোরে।’ প্রত্যক্ষদর্শী অনন্ত কুমার সিংহ প্রথম আলোর সাংবাদিককে এই কথাগুলো জানিয়েছিলেন। পুলিশের হাতে আটক চালক আবদুল মজিদ স্বীকার করেছেন যে তিনি জেনে-বুঝেই কাজিট করেছেন। উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ কর্মকর্তা মো. আলী হোসেন খান জানাচ্ছেন যে তাঁর কাছেও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আবদুল মজিদ বলেছেন যে ‘ওই সিএনজিচালক আমার সঙ্গে তর্ক করছিল। তাই তাকে পিষে দিয়েছি।’ (মানবজমিন, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫)। কী ভয়াবহ! কিন্তু একই সঙ্গে লক্ষণীয়,
আবদুল মজিদ এই নিয়ে চিন্তিত নন, কেননা তিনি এভাবেই ভাবেন। কখনো কখনো একটি-দুটি ঘটনা সমাজের ভেতরের অদৃশ্য প্রবণতাকে তুলে ধরে। কিন্তু যখন একই ধরনের ঘটনা উপর্যুপরিভাবে ঘটে, তখন একে আমরা অদৃশ্য প্রবণতা না বলে সমাজের ছবি বলেই গণ্য করব। কয়েক মাস ধরে আমরা যেসব নৃশংস ঘটনা দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো আপাতদৃষ্টে রাজনৈতিক নয় বলে আমরা সাধারণত এই নিয়ে খুব বেশি বিচলিত হই না। কিন্তু আমাদের কি প্রশ্ন করা উচিত নয় যে কী কারণে সমাজের ভেতরে সহিংসতার এই মানসিকতা বিস্তার লাভ করে এবং করেছে? কীভাবে এ ধরনের অমানবিকতা সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজে আর কত দিন আমরা নিজেদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মত্ত থাকব? আবদুল মজিদ তাঁর চেয়ে ছোট এবং দুর্বল বলে যাঁকে দেখেছেন, সেই মোহাম্মদ ফারুককে পিষে দিয়েছেন। এটি মর্মান্তিক ঘটনা। কিন্তু আমার কাছে এ ঘটনাকে খুব বিস্ময়কর মনে হয় না এই অর্থে যে বাংলাদেশের সমকালীন সমাজে পিষে দেওয়ার মানসিকতা সর্বব্যাপ্ত, সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। আকারে ও শক্তিতে যাঁরা নিজেদের বড় মনে করেন, তাঁরা তুলনামূলকভাবে ছোটদের ওপর চড়াও হন। তাঁর যদি অর্থ, বিত্ত, প্রভাব, ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য থাকে, তবে তো সোনায় সোহাগা। রাষ্ট্র যদি তাঁর পক্ষে দাঁড়ায়, তবে তো কথাই নেই। ‘পিষে মারা’র একটি প্রকাশ হচ্ছে পিটিয়ে মারা।
এ মাসের গোড়ার দিকে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ডাকাত সন্দেহে আটজনকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে; যদিও অনেকেই হয়তো মনে করতে পারবেন না যে এই বছরের ২৫ জানুয়ারি নরসিংদী সদরে ডাকাত সন্দেহে বা অভিযোগ তুলে সাতজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ বছরের মাঝামাঝি পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো যেসব তথ্য দিয়েছিল, সেই হিসাবে সাড়ে ছয় বছরে কথিত ‘গণপিটুনি’তে ৯০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংবাদপত্র যাকে ‘গণপিটুনি’ বলে বর্ণনা করে, তা আসলে বিচারবহির্ভূত হত্যার একটি রূপ। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে এ ধরনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬৮ জন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে ব্যক্তিগত শত্রুতা—সবই এসব ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু পিটিয়ে মারার ঘটনা একা ঘটে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাতে যোগ দেন অনেকে। আবদুল মজিদ যাঁকে ‘পিষে মারা’ বলছেন, আক্ষরিকভাবে তা–ই দেখতে পাই এই পিটিয়ে মারার মধ্যে, কিন্তু তাতে অংশ নেন অনেকে। যদি বলি, আসলে পিষে মারতে চাওয়ার মানসিকতা কেবল আবদুল মজিদের নয়, তা হলে কি অতিরঞ্জন হবে? সমাজে যাঁদের শক্তি আছে, তাঁরা প্রতিপক্ষকে ‘পিষে মারতে’ চান। সেই লক্ষ্যে তাঁরা তাঁদের শক্তিকে ব্যবহার করতে মোটেই কুণ্ঠিত হন না। সমাজে যাঁরা সংখ্যালঘু বলে পরিচিত—ধর্মবিশ্বাসে, জাতীয় পরিচয়ে,
রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে—তাঁরা প্রতিদিন বুঝতে পারেন যে এই পিষে মারার চেষ্টা কত প্রবল। সমাজে ও রাজনীতিতে ক্ষমতাবানেরা অন্যদের কথা শুনতে চান না, তাঁদের সঙ্গে ‘তর্ক’ করলে তাঁরা যাঁরা তর্ক করেন, তাঁদের যেভাবে পারেন ‘পিষে মারতে’ উদ্যোগী হন। এই পিষে মারা সব সময় শারীরিক হতে হবে তা নয়। পিষে মারার ভিন্ন পথও আছে। খানিকটা ‘পিটিয়ে মারার’ মতো ঘটনা। এমন মনে করার কারণ নেই যে পিটিয়ে মারায় অংশগ্রহণকারী সবাই সম্যকভাবে অবহিত কেন তাঁরা পিটিয়ে মারছেন। যাঁরা অংশ নিচ্ছেন, তাঁরা কোনো না কোনো কারণে, কোনো না কোনোভাবে এ ঘটনায় যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের উজ্জীবিত করে ‘গোষ্ঠী’ বা ‘মব’ (Mob)-এ পরিণত করা হয়েছে। এই একই অবস্থা আপনার কথা বলার ব্যাপারে, চিন্তার ব্যাপারেও হতে পারে। ব্লগার বলে পরিচিত পাঁচজন লেখক এবং একজন প্রকাশক যে খুন হলেন, তা আসলে শারীরিকভাবে ‘পিষে’ ফেলাই। কিন্তু তার বাইরেও ক্রমাগতভাবে শক্তি প্রয়োগের উদাহরণ আছে। আপনার তর্ক করার অধিকার যখন অগ্রাহ্য হচ্ছে, সেটা আইনের মোড়কেই হোক কিংবা আইনের বাইরেই হোক, সেটা আসলে আপনার কণ্ঠকে বা প্রকারান্তরে আপনাকে ‘পিষে’ ফেলা।
যখন আপনার ওপরে গোষ্ঠীগতভাবে মৌখিক আক্রমণ হচ্ছে, তখন একে পিষে ফেলার চেষ্টা বলেই অনুমান করা যায়; আপনার কথা আগামভাবে বন্ধ করার মানসিকতা কেন ভিন্ন বলে জানব? এই প্রচেষ্টাগুলো যখন একটি ভাবাদর্শের ছায়ায় পরিচালিত হয়, তখন তা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। কেননা ভাবাদর্শ তাঁকে বৈধতা দেয়। সেই সময় চিন্তার স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়। এ কাজে রাষ্ট্র যখন অগ্রণী, তখন তা কেবল উদ্বেগের জায়গায় থাকে না। বাসচালক আবদুল মজিদ নিরীহ অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ ফারুককে পিষে ফেলেছেন; বাসযাত্রীরা তাঁকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। আমরা আশা করি, আবদুল মজিদের বিচার হবে, তাঁর যথাযথ শাস্তি হবে। এও আশা করি, ফারুকের অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা হবে। কিন্তু সমাজে যে এই প্রবণতা বাড়ছেই, তার কী হবে? সমাজে যে দুর্বলকে পিষে ফেলার অব্যাহত চেষ্টা, ভিন্নমতকে পিষে ফেলার নিরন্তর চেষ্টা—সেটা নিয়ে আমরা সরব হব কবে? আমাদের ভেতরে যে অন্যকে পিষে ফেলার মানসিকতা, তা থেকে মুক্তির পথ কি আমরা অনুসন্ধান করছি?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.