গভীর রাতে র‌্যাবের অভিযান, ২ জঙ্গি নিহত

জেএমবির তিন সদস্যকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর
একটি বাসা থেকে গত শনিবার গভীর রাতে
অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।
গাজীপুরে র‌্যাবের অভিযানে সময় দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। র‌্যাবের দাবি, নিহত দুজনই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সক্রিয় সদস্য ছিল। ঘটনার সময় একজন র‌্যাব সদস্য মাসুদ আহত হয়েছেন। গতকাল ভোরে নিহত দুজনের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, অবিস্ফোরিত বোমা এবং তাদের ব্যাগ থেকে বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও জেএমবির সাংগঠনিক ও জিহাদি বই উদ্ধার করা হয় বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি এবং বিকাল পৌনে ৪টায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মামুনের উপস্থিতিতে হাসপাতাল মর্গে থাকা মরদেহ দুটির সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির পর ময়নাতদন্ত করা হয়। নিহতদের পরিচয় সম্পর্কে র‌্যাব ও পুলিশ কেউই কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
অভিযান শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, রোববার রাত সাড়ে ১১টায় গাজীপুর মহানগরের যোগীতলায় একটি পরিত্যক্ত ভবনে এ অভিযান চালায় র‌্যাব। তাদের কাছে খবর ছিল, জঙ্গিরা পরিত্যক্ত ভবনে অবস্থান করছে। অভিযান চলাকালে ভবনে উপস্থিত জঙ্গিরা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করে। র‌্যাবও পালটা গুলি চালায়। জঙ্গিদের বোমা হামলায় র‌্যাবের একজন সদস্যও আহত হন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অভিযান শেষে ভবনের ভেতরে গিয়ে দুটি মৃতদেহ দেখতে পান র‌্যাব সদস্যরা। র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ বলেন, নিহতদের পরিচয় জানা যায়নি। তবে তারা জেএমবির সক্রিয় সদস্য ছিল বলে ধারণা করছেন। নিজেদের বোমার আঘাতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে র‌্যাবের এ কর্মকর্তার ধারণা।
র‌্যাব সূত্র জানায়, ঘটনাস্থল থেকে চারটি অবিস্ফোরিত হাতে তৈরি গ্রেনেড (ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস-আইইডি) উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। আর জঙ্গিদের বিস্ফোরিত বোমায় র‌্যাব সদস্য আহত হয়েছেন। জঙ্গিদের কাছে থাকা একটি ব্যাগ থেকে বেশ কিছু বিস্ফোরক, ডেটোনেটরসহ গ্রেনেড তৈরির উপকরণ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে ৫ রাউন্ড গুলি, একটি পিস্তল, বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও জেএমবির সাংগঠনিক বই উদ্ধার করেছে র‌্যাব। ঘটনাস্থলে শুধু ওই দুজনই ছিল দাবি করে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, র‌্যাব সদস্যরা জায়গাটি চারদিক থেকে ঘেরাও করে অভিযান শুরু করে। এ কারণে ঘটনাস্থল থেকে কেউ পালাতে পারেনি। তারা নাশকতার পরিকল্পনা করছিল বলে ধারণা র‌্যাব কর্মকর্তাদের।
সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, নগরের যোগীতলা এলাকার ঢাকা বাইপাস সড়কের পাশের প্রায় এক বিঘা জমিতে দেয়া বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরে জমির উত্তর-পূর্ব কোনায় ইটের তৈরি পরিত্যক্ত ছোট একটি ঘর রয়েছে। ওই ঘরের মেঝেতে এক জোড়া জুতো ও ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে আছে। বিপুলসংখ্যক উৎসুক জনতার ভিড় দেখা গেছে অভিযান চালানোর ওই ঘরটি ও আশপাশের এলাকায়। দরজা-জানালাবিহীন যে ঘরটিতে জঙ্গিরা অবস্থান নিয়েছিল ওই জমির মালিক নগরের যোগীতলা এলাকারই সাইফুল ইসলাম। সে নগরের টঙ্গীতে বসবাস করে। ঘটনাস্থলের আশপাশের স্থানীয় লোকজন জানান, রাতের আঁধারে তারা গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন। তবে ভয়ে কেউ বাইরে বের হননি। যে ঘরটিতে অভিযান পরিচালিত হয়েছে, দরজা-জানালাবিহীন পরিত্যক্ত ছোট ওই ঘরটির লাগোয়া কোনো বাড়িঘর নেই। ওই ঘরটিতে জেএমবির স্থায়ী কোনো আস্তানা ছিল কিনা- সে সম্পর্কেও এলাকাবাসী কোনো তথ্য জানাতে পারেননি। তবে অনেকেই বলেছেন, গ্রামের মতোই কমসংখ্যক বাড়িঘর থাকা এবং অনেকটা নির্জন ওই এলাকার বাইপাস সড়কে মাঝে মাঝে ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। যোগীতলা এলাকার বাসিন্দা নুরু মিয়া জানান, রোববার রাতে খাবার খেয়ে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত আনুমানিক ১১টার পরে হঠাৎ বিকট একটি শব্দ পাওয়া যায়। এরপর ৫-৬টি গুলির শব্দ পাওয়া যায়। পরে র‌্যাবের লোকজন হ্যান্ড মাইকে তারা অভিযান চালাচ্ছে বলে ঘোষণা দেয়। পরে এলাকার লোকজন যার যার বাড়িতে চলে যান।
এদিকে দুই জঙ্গি নিহত হওয়ার পর তাদের আগের দিন দুপুরে কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারের সামনে থেকে আটক করে নিয়ে যায়। গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুনুর রশীদও জানান, র‌্যাব কারাগারের সামনে থেকে মিনহাজ ও মাহাবুব নামে দণ্ড শেষে ছাড়া পাওয়া দুই জঙ্গিকে ধরে নিয়ে গেছে। তারাই যে নিহত ব্যক্তি এ বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যে দুজনকে ধরে আনা হয়েছিল তাদের রাতেই তাদের স্বজনদের কাছে ফেরত দেয়া হয়েছে। এমনকি মিনহাজ নামে যে জঙ্গির মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, তার বোন ও দুলাভাই এবং মিনহাজের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেছে। মিনহাজ বর্তমানে তাদের গ্রামের বাড়িতে রয়েছে।
চট্টগ্রামে ৩ জঙ্গির পাঁচ দিনের রিমান্ড
চট্টগ্রামে অস্ত্রসহ ধরা পড়া ৩ জেএমবি জঙ্গি সদস্যের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম রহমত আলীর আদালতে এই রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এই সময় জঙ্গিদের মাথায় হেলমেট পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। বাড়ানো হয় অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জানতে চাইলে এই বিষয়ে মানবজমিনের সঙ্গে কথা বলেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) কাজী মুত্তাকী ইবনু মিনান। তিনি বলেন, জঙ্গিদের আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে নগরীর কর্ণফুলী থানায় দায়ের হওয়া মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন করে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেছিল পুলিশ। পরে শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেককে পাঁচ দিন করে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন। এই সময় তিন জেএমবি নেতা ও সদস্যকে চিন্তিত দেখা গেছে। আদালত সূত্র জানায়, আমানবাজারের আস্তানার সন্ধানদাতা জেএমবির তিন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করার সময় আদালতে প্রচুর সংখ্যক পুলিশ দেখা যায়। রিমান্ডে নেয়া ৩ জঙ্গি আসামির মধ্যে নগরীর কাজীর দেউড়ি থেকে নাইমুর রহমান, নালাপাড়া থেকে ফয়সাল মাহমুদ ও কসমোপলিটন এলাকা থেকে মো. শওকত রাসেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই তিন জেএমবি সদস্যই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানা পুলিশ জানায়, গত ২৭শে ডিসেম্বর রাতে হাটহাজারীর আমানবাজারের আস্তানা থেকে গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনায় অস্ত্র এবং বিস্ফোরক আইনের পৃথক ধারায় স্থানীয় থানায় প্রথমে দুটি মামলা করে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফররুখ আহমেদ মিনহাজ। তারও আগে গত ৫ই অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর এলাকায় জেএমবির আরও একটি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের মধ্যে সবার পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলো নাইমুর রহমান নয়ন। পিতার নাম মাজহারুল আলী, গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী থানার পূর্ব সাঞ্জুয়ার ভিটা এলাকায়। নগরীর পাঁচলাইশের হিলভিউ আবাসিক এলাকার সরোয়ার এন্ড মোজাম্মেল ভিলা, ২নং গেইট এলাকায় ভাড়া থাকতেন।  গ্রেপ্তার অপর ব্যক্তির নাম ফয়সাল মাহমুদ (২৬)। তার পিতার নাম মৃত ছায়েদুল হক। নোয়াখালীর সেনবাগের উত্তর মোহাম্মদপুর এলাকায় তার গ্রামের বাড়ি। প্রায় ৫ মাস ধরে নগরীর কোতোয়ালীর উত্তর নালাপাড়ার ১৩নং বাসার ৪র্থ তলা ভাড়া নিয়ে তিনি জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। তাদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয় শওকত রাসেল (২৬)। তার পিতার নাম নুরুল আমিন। কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানার গটিডাঙ্গা চেয়ারম্যান বাড়ির নুরুল আমিনের পুত্র তিনি। আটক হওয়ার আগে তার ঠিকানা ছিল শহরের পাঁচলাইশের কসমোপলিটন লেইন এলাকায়। র‌্যাব জানায়, গত ২৬শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এই ৩ সদস্যকে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারীতে রাতভর অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী উদ্ধার করা হয় অত্যাধুনিক এমকে-১১ অটোমেটিক স্নাইপার রাইফেল, গুলি, ডেটোনেটর, র‌্যাংক ব্যাচসহ সেনাবাহিনীর পোশাক ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য। পাওয়া যায় জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টও। পুলিশ জানিয়েছে, আটককৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে তারা জেএমবির সদস্য। এই বিষয়ে জানতে চাইলে মানবজমিনের সঙ্গে কথা হয় পুলিশ কর্মকর্তা ও অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া অতিরিক্ত উপকমিশনার বাবুল আকতারের সঙ্গে। তিনি বলেন, মূলত জঙ্গি নেতা ফারদিনকে ধরতেই আমরা গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে শুনি সে ঢাকায় চলে গেছে। এসব অস্ত্র দিয়ে পুরো চারটি ভবন উড়িয়ে দেয়া যায়।’ তিনি আরও বলেন, শহরে না থেকে কিছুটা গ্রামের সাইডে এসে আস্তানা গাড়ছে জঙ্গিরা। বাড়ির মালিক আমাদের জানিয়েছেন জঙ্গি ফারদিন ও তার স্ত্রী এখানে থাকতেন না। তারা ১৫ দিন পর একবার আসতেন। ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। নগরীতে জঙ্গি আস্তানায় আরও বেশ কিছু অভিযান চালানো হবে। অভিযানে স্নাইপার রাইফেল ছাড়াও ২৫০ রাউন্ড গুলি, দুই কেজি জেল এক্সপ্লোসিভ, ১০টি ডেটোনেটর, বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম, সেনাবাহিনীর ১৪টি পোশাক, নেমপ্লেট ও বেইজ র‌্যাংক, সাংগঠনিক বিভিন্ন নথিপত্র পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.