ইতালীয় নাগরিক হত্যা: তিন সন্দেহভাজনের বাসায় দূতাবাসের কর্মকর্তারা by নজরুল ইসলাম

ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যায় তিন সন্দেহভাজনের বাসায় গিয়ে তাঁদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন ঢাকায় ইতালীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা। এঁদের মধ্যে বিএনপির নেতা সাবেক কমিশনার এম এ কাইয়ুমের ছোট ভাই এম এ মতিনও রয়েছেন।
গতকাল বুধবার মধ্যরাতে ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় গতকাল বেনাপোল থেকে মতিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মিনহাজুল আরেফিন রাসেলের জবানবন্দিতে মতিনের নাম এসেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।
সিজার তাবেলা হত্যা মামলায় গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) এ পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। এঁদের মধ্যে যে দুজনের বাসায় ইতালীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা গিয়েছেন, তাঁরা হলেন তামজিদ আহম্মেদ রুবেল (৩৫) ও শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরিফ (৩৫)। গ্রেপ্তার বাকি দুজন হলেন মিনহাজুল আরেফিন রাসেল (৪০) ও রাসেল চৌধুরী (৩৫)। এঁদের মধ্যে রাসেল চৌধুরী ছাড়া বাকি তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। রাসেল চৌধুরীকে গত মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
গত মঙ্গলবার মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাটে তামজিদের বাসায় গেলে তাঁর মামা মাইনউদ্দিন আহমেদ ওরফে তৌহিদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৭ অক্টোবর বেলা তিনটার দিকে দুজন বিদেশি তাঁদের বাসায় যান। তাঁরা নিজেদের ইতালীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। এঁদের একজন ইংরেজিতে কথা বলেন, আরেকজন ছিলেন দোভাষী। দোভাষী ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে কথা বলে তা ইংরেজিতে রূপান্তর করে সঙ্গী কর্মকর্তাকে বলেছেন এবং তিনি ল্যাপটপে তা লিখে নিয়েছেন।
মাইনউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তামজিদকে কবে, কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাঁর বিষয়ে কেন বাড্ডা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে, তা জানতে চান কর্মকর্তারা। জবাবে তিনি বলেছেন, তামজিদ ১২ অক্টোবর নিখোঁজ হন। ২১ অক্টোবর তাঁরা বাড্ডা থানায় জিডি করেন। ২৬ অক্টোবর টিভি দেখে তাঁরা জানতে পারেন, তাঁকে ইতালির নাগরিক হত্যায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ তাঁকে কয়েক ঘণ্টা আগে ধরেছিল বলে দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে।
মাইনউদ্দিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বলেছেন, তামজিদের বিরুদ্ধে আগে থানায় কোনো মামলা কিংবা জিডি ছিল না। তাঁর বাসায় এর আগে কখনো পুলিশও আসেনি। তামজিদ তাঁদের কিছু বলেছেন কি না—ইতালীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের এই প্রশ্নের জবাবে মাইনউদ্দিন বলেছেন, ডিবি পুলিশের চাপের মুখে তামজিদ হত্যার দায় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন বলে তাঁদের জানিয়েছেন। এ ছাড়া কারাগারে দেখা করতে গেলে তামজিদকে তাঁরা খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছেন।
শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরিফের মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাটের বাড়িতে ইতালীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা গিয়েছেন গত ১৬ অক্টোবর বেলা তিনটায়। বাড়ির তত্ত্বাবধানকারী মো. রিপন গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, দুজনের একজন ইংরেজিতে কথা বলেছেন, আরেকজন বাংলায়। কর্মকর্তারা জানতে চেয়েছেন, শাখাওয়াত কবে, কোথা থেকে, কীভাবে ধরা পড়লেন? জবাবে তিনি বলেছেন, ১৪ অক্টোবর মধ্যরাতে সাদা পোশাকের ১৪-১৫ জন এসে নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিলে তিনি বাড়ির প্রধান ফটক খুলে দেন। এরপর তাঁরা সরাসরি ছয়তলায় শাখাওয়াতের ঘর থেকে তাঁকে আটক করেন। ওই সময় শাখাওয়াতকে হাতুড়িপেটাও করা হয়। ওই সময় তাঁরা গ্যারেজে থাকা শাখাওয়াতের মোটরসাইকেলটি টেনে রাস্তায় নিয়ে তালা ভেঙে ফেলেন এবং সেটি নিয়ে যান। এই মোটরসাইকেলটি হত্যার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। ২৬ অক্টোবর ডিবি পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে শাখাওয়াতকে গ্রেপ্তার ও মোটরসাইকেল উদ্ধারের কথা জানায়।
ইতালীয় দূতাবাসের কর্মীরা বাড়ির তত্ত্বাবধানকারী মো. রিপনের কাছে জানতে চান শাখাওয়াতের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা আছে কি না। তিনি তাঁদের জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। শাখাওয়াতের বড় ভাই মোহাম্মদ হোসেন ভূঁইয়া এই কথোপকথনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামির পরিবারের সঙ্গে ইতালীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা কথা বলেছেন কি না, জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মো. জিহাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দূতাবাস চাইলে আসামিদের বিষয়ে নিজেদের মতো করে খোঁজখবর নিতে তাঁদের বাসায় যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে তাঁকে তারা কিছু জানায়নি।
অভিযুক্তদের বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে গতকাল দুপুরে জানতে চাইলে ঢাকায় ইতালীয় দূতাবাসের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে দূতাবাসের সূত্র নিশ্চিত করেছে, রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা ও দূতাবাসের কনসুলার বিভাগের প্রধান জভানি চিয়ানি এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সরাসরি খোঁজ-খবর রাখছেন।
দুই আসামির জবানবন্দিতে হত্যায় জড়িত হিসেবে ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার এম এ কাইয়ুমের ছোট ভাই এম এ মতিনের নাম এসেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। তাঁর বাসাও মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাটে। দিন তিনেক আগে ইতালীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা পরিচয়ে দুজন তাঁদের বাসায়ও যান।
মতিনের স্ত্রী মুসাররাত জাহান দিলরুবা প্রথম আলোকে বলেন, দুই ব্যক্তি তাঁদের ইতালীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তাঁদের বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা নিরাপত্তাকর্মীর কাছে জানতে চান মতিন কোথায় আছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কি না। জবাবে নিরাপত্তাকর্মী তাঁদের বলেছেন, ২০ অক্টোবর এশার নামাজে যাওয়ার সময় বাসার কাছ থেকে সাদা পোশাকের কিছু ব্যক্তি ডিবি পরিচয়ে মতিনকে তুলে নিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত তাঁর খোঁজ মেলেনি। নিরাপত্তাকর্মী তাঁদের জানিয়েছেন, মতিনের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা কিংবা জিডি নেই।

No comments

Powered by Blogger.