স্কুলে মানা আসিয়া-সাদিয়ার by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

বাবার ৩ বিয়ে, আবার প্রথম দুই মায়ের আরও একটি করে বিয়ে। কিন্তু এত মা-বাবার ভিড়েও ‘মা-বাবার স্নেহ’ তারা কখনোই পায়নি। নির্যাতন সইতে না পেরে ছোট্ট তিন ভাইবোন ঘর ছেড়ে পালিয়েছিল। এখন আছে ফুপুর কাছে। নতুন এক সমস্যায় পড়েছে তারা। মা-বাবার স্নেহবঞ্চিত শিশুগুলোর দিক থেকে এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাদের স্কুল। এমন ‘লক্ষ্মীছাড়া’দের আর স্কুলে নেয়া হবে না। তাদের কারণে ‘নষ্ট’ হবে স্কুলের অন্য শিশুরা। ইতিমধ্যেই স্কুলের অনেক ‘বদনাম’ হয়েছে। সিলেটের কাজলশাহ রাধারানী প্রাইমারি স্কুল থেকে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে আসিয়া ও সাদিয়াকে আর স্কুলে রাখা হবে না। তিন ভাইবোনের মধ্যে আসিয়া আর সাদিয়াই কেবল স্কুলে পড়ে, ছোট্ট ইরহামের এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি।
রাধারানী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী আসিয়া আক্তার তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। এরপর সাদিয়া আক্তার- সে পড়ে একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে। সবার ছোট ৪ বছর বয়সী ইরহাম হোসেন এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। তারা সিলেট নগরীর কাজলশাহ এলাকার ৪৩/১ নম্বর বাসার বাসিন্দা দুলাল আহমদের সন্তান। বাবা এক হলেও তিন ভাইবোন একই মায়ের সন্তান নয়। আসিয়ার মা একজন। সাদিয়া ও ইরহামের মা অন্য আরেকজন। তবে কোন মায়েরই স্নেহ তাদের ভাগ্যে জোটেনি। দুজনই তাদের বাবাকে ছেড়ে আলাদা আলাদা সংসার পেতেছেন। তাই আসিয়ারা থাকতো অন্য আরেক মায়ের সঙ্গে যিনি তাদের বাবার তৃতীয় স্ত্রী। পঞ্চগড়ের মেয়ে সেলিনা বেগমকে বছর চারেক আগে বিয়ে করেছেন আসিয়ার বাবা দুলাল। নতুন সেই মায়ের নির্যাতনের কারণেই ঘরছাড়া হয় তিন ভাইবোন।
সুযোগ পেলেই তিন ভাইবোনকে গালিগালাজ ও মারধর করতেন সেলিনা। বাবার কাছে নালিশ জানিয়েও কোন লাভ হতো না। উল্টো বাবার হাতে আরেক দফা পিটুনি খেতে হতো। গত ৭ই অক্টোবর বিকালে দশ বছর বয়সী আসিয়াকে ‘প্রেম’ করার অভিযোগে চুল ধরে টেনে মারধর করেন সেলিনা। একপর্যায়ে গাছের ডাল দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্তও করেন তাকে। বাইরে কাজ থাকায় মারধরের পর ঘর থেকে বেরিয়ে যান সেলিনা। শাসিয়ে যান ফিরে এসে শিক্ষা দেবেন। আসিয়া সিদ্ধান্ত নেয় আর থাকবে না এখানে। মা বেরিয়ে যেতেই ঘরে থাকা ৪ হাজার টাকা খুঁজে বের করে সে। প্রতিবেশী এক খালার কাছ থেকে মায়ের কথা বলে নেয় আরও ৫শ টাকা। তারপর স্কুলব্যাগে বই-আর কাপড় চোপড় নিয়ে ছোট্ট দুই ভাইবোনকে সঙ্গে নিয়ে পা বাড়ায় অজানার পথে। হেঁটে আসে মূল রাস্তায়- সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে। রিকশা নেয় রেল স্টেশন যাবে বলে। তিন ভাইবোন উঠে পড়ে ঢাকার ট্রেনে।
সিরাজগঞ্জে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাবে বলে পরিবার নিয়ে সে ট্রেনে চেপেছিলেন সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার মাঠগাঁও গ্রমের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম। তাদের পাশের সিটেই বসেছিল  আসিয়ারা। অভিভাবকহীন তিনটি শিশুকে দেখে কৌতূহল হয় কামরুল ইসলামের। জানতে চান তারা কার সঙ্গে এসেছে, কোথায় যাবে। আসিয়া জবাব দেয়, তাদের কেউ নেই। কয়েক মাস আগে বাবা বিয়ে করে তাদের একা রেখে চলে গেছেন। তারা এক বাসায় কাজ করতো। সেখান থেকে চলে এসেছে। ঢাকায় যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। কামরুল ইসলাম তাদের কাছ থেকে ঠিকানা উদ্ধারের চেষ্টা করেন। আর আত্মীয়স্বজন কেউ আছে কিনা জানতে চান। কোন তথ্যই উদ্ধার করতে পারেন না। শেষমেশ যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে পড়েন কামরুল ইসলাম।
বিমানবন্দর স্টেশন থেকে সিরাজগঞ্জগামী ট্রেনে চাপেন কামরুল ইসলাম। যমুনার উপর দিয়ে বয়ে ট্রেন পৌঁছে সিরাজগঞ্জের শহীদ মনসুর আলী রেল স্টেশনে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ট্রেন থেকে নামেন কামরুল ইসলাম। পেছন থেকে শিশু কণ্ঠে কেউ তাকে ডাক দেয় ‘মামা’ বলে। পেছনে তাকিয়ে দেখেন ছোট্ট সে তিন ভাইবোন। অবাক হয়ে যান তিনি। তাদের পিছু নিয়ে চলে এসেছে ‘এরা’! কাছে এগিয়ে আসে আসিয়া। কামরুল ইসলামকে অনুরোধ করে তাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কি করে ফেলে যান ছোট্ট তিন শিশুকে। আবার সঙ্গেও যে নেবেন কোন ভরসায়। ভয়, যদি কোন ঝামেলায় জড়ান, যদি অপহরণের অভিযোগ উঠে। তবুও সঙ্গে নেন শিশুদের। ভেবেচিন্তে ফোন দেন নিজের ইউনিয়ন দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে। তাকে বিস্তারিত জানিয়ে থানায় একটি জিডি করার অনুরোধ করেন। আসিয়াদের ব্যাগ খুলে বই দেখে তিনি জানতে পেরেছিলেন ওরা সিলেটের কাজলশাহ রাধারানী স্কুলে পড়ে। সে তথ্যও দেন চেয়ারম্যানকে। চেয়ারম্যান জানান, জিডি করতে হলে শিশুদের উপস্থিত করতে হবে থানায়।
কামরুল ইসলাম বেড়াতে এসেছিলেন তার শ্যালকের শ্বশুরবাড়িতে। এটাই প্রথম আসা। দিন দশেক থাকার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সঙ্গী হওয়া অসহায় শিশুদের একটা উপায় করতে ৪ দিনের মাথাতেই ফিরে আসেন সিলেটে। পরে পুলিশের মাধ্যমে সন্ধান মেলে আসিয়ার স্বজনদের। জানা যায় সৎ মায়ের নির্যাতন সইতে না পেরে পালিয়েছিল তারা। আসিয়াদের তুলে দেয়া হয় ফুপু জোসনা বেগমের কাছে। আদালতই ফুফুর জিম্মায় দিয়েছে তাদের। ফুপুর কাছে থাকলেও তিন ভাইবোনের ভরণ পোষণের খরচ দেয়ার কথা বাবা দুলাল আহমদের। কিন্তু এ ব্যাপারে তার কোনও গরজ নেই। এমনকি ফিরে আসার পর একবার ফুপুকে দেয়ার জন্য টাকা চাইতে গেলে আসিয়াকে তাড়িয়ে দেন দুলাল আহমদ।
আসিয়াদের তাড়িয়ে দিতে চাইছে এখন তাদের স্কুলও। ফিরে আসার পর তাদের আর স্কুলে ক্লাস করতে দেয়া হয়নি। রাধারানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অশোকা ভট্টাচার্য জানিয়ে দিয়েছেন এদের তিনি তার স্কুলে পড়তে দেবেন না। যারা ঘর থেকে পালিয়ে যায় এমন ‘বাজে’ মেয়েদের স্কুলে কোন জায়গা নেই। বার্ষিক পরীক্ষার মাসখানেক বাকি আছে। আসিয়ার ফুপু জোসনা বেগম নিজে গিয়ে রোববার অনুরোধ করে এসেছেন অন্তত পরীক্ষাটা দিতে দেয়া হোক। কিন্তু তাতেও রাজি হননি প্রধান শিক্ষিকা। তার এক কথা- স্কুলের ‘সুনাম’ কিছুতেই নষ্ট হতে দেবেন না। প্রয়োজনে ছাড়পত্র দেবেন, তবুও এ স্কুলে আর পড়তে দেবেন না।
আসিয়ারা কেন ঘর ছেড়েছিল সে খোঁজ কেউ করছে না। ছোট্ট এ তিন ভাইবোনের সব আছে। বাবা আছে, মা আছে। কিন্তু নেই বাবার আদর, মায়ের স্নেহ।  আসিয়াদের বাবা দুলাল আহমদ ২০০১ সালে প্রথম বিয়ে করেন চাঁদপুরের মেয়ে রওশন আরাকে। সে ঘরেই জন্ম আসিয়ার। কিন্তু এক বছরও সে মায়ের সান্নিধ্য পায়নি। তাকে ৮ মাস বয়সী রেখেই মা অন্য আরেকজনকে বিয়ে করেন। আসিয়ার ঠিকানা হয় ফুপুর কাছে। বছর চারেক পর দুলাল আহমদ বিয়ে করেন ইমরানা বেগমকে। মেয়েকে নিয়ে যান। নতুন সংসারে জন্ম হয় আসিয়ার দুই ভাইবোন সাদিয়া ও ইরহামের। ইমরানাও নতুন ঘরের সন্ধান পেয়ে দুলাল আহমদের ঘর ছাড়েন ছেলেমেয়েদের রেখেই। রওশন আরা ও ইমরানা দুজনেরই অভিযোগ দুলাল আহমদ তাদের নির্যাতন করতেন। একলা থাকেননি দুলাল আহমদ, বছর তিনেক আগে বিয়ে করেন সেলিনা বেগমকে। ছেলেমেয়েরা ছিল নতুন মায়ের সঙ্গে, তবে মোটেও সুখে ছিল না।
আসিয়ারা বড়ই দুর্ভাগা। হারিয়ে যাওয়ার পরও তাদের জন্য মায়েদের চোখে জল ঝরেনি। আসিয়ার ফুপুদের চাপে ইমরানা দুয়েকবার থানায় গেলেও রওশনআরা কোন খোঁজই করেননি। বাবারও তেমন গরজ ছিল না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরও মাথাব্যথা নেই এ নিয়ে। তিনটি শিশু হারিয়ে গেলো, ফিরে এলো, তাদের স্কুলে ভর্তি হতে দিচ্ছে না, কোন কিছুই কাউকে ভাবাচ্ছে না।
কথা হয় রাধারানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অশোকা ভট্টাচার্যের সঙ্গে। মানবজমিনকে তিনি বলেন, বাচ্চাদের স্কুলে না রাখার বিষয়টি আমার একার সিদ্ধান্ত নয়। স্কুলের একটি কমিটি রয়েছে-রয়েছে এলাকাবাসীর চাপ। অন্য শিশুদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা কেউই চান না এ বাচ্চারা স্কুলে আসুক।

No comments

Powered by Blogger.