পরীক্ষা মানেই প্রশ্ন ফাঁস! হতাশ শিক্ষার্থী চাকরিপ্রার্থী ও অভিভাবক by মেহেদী হাসান

পরীক্ষা মানেই প্রশ্নপত্র ফাঁস; এটিই যেন এখন স্বাভাবিক ঘটনা। প্রশ্নপত্র ফাঁস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায়ও এখন এটি ঘটতে শুরু করেছে। পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ পরীক্ষায় একের পর এক ঘটে চলেছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। ২০০৯ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে পরিমাণ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি অতীতে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত চার বছরে বিভিন্ন পরীক্ষায় মোট ৬৩টি বিষয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। অপর একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় একই সময়ে ৩০টিরও বেশি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ও অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত কয়েক বছরে প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের রেকর্ড সম্পন্ন হয়েছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, চাকরি প্রার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যেও দীর্ঘ দিন ধরে বিরাজ করছে তীব্র ক্ষোভ এবং হতাশা। বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রমাণিত হলেও বাতিল করা হয়নি পরীক্ষা। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে মূল প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেলেও অনেক সময় কর্তৃপক্ষ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। কখনো কখনো সাজেশন বলেও বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেককে গ্রেফতার করা হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন কোনো নজিরও চোখে পড়ছে না। অনেকের মতে এসব কারণেই থামছে না প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারি।
গত কয়েক বছরে শিক্ষা খাত সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায়। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন কারণে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় একের পর এক কেলেঙ্কারি যেন লেগেই আছে। এ মুহূর্তে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে রয়েছেন মেডিক্যালে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা।
চলমান শিক্ষক আন্দোলনের মধ্যেই ঘটে যায় দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন তথা ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন। এ আন্দোলন শেষ না হতেই আবার মাঠে নামলেন মেডিক্যালে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার আগের রাত থেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে এবং এ অভিযোগে সরকারি চাকরিজীবী ও চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃতদের একজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বরের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা গ্রহণের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা।
পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস উৎসব
২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৪ সাল ছিল পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের হিড়িকের বছর। ২০১৪ সালে বছরজুড়ে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় ঘটতে থাকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। সমাপনী, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় প্রায় প্রতিটি বিষয়ে মুড়ি মুড়কির মতো মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র। এ ছাড়া জেএসসি বা জেডিসি পরীক্ষায়ও তখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।
২০১৪ সালে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার শুরু থেকেই প্রতিটি বিষয়ে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা এবং অভিযোগ আসতে থাকে। ফাঁস হওয়া অনেক প্রশ্নের সাথে পরীক্ষার হলের প্রশ্নপত্র হুবহু মিলে যায়। তারপরও একটি পরীক্ষা স্থগিত ছাড়া অন্যসব পরীক্ষা চালিয়ে নেয়া হয়। ২০১৪ সালে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্নপত্র ফাঁস ছিল এইচএসসির। পরিস্থিতি বেগতিক আকার ধারণ করায় স্থগিত করা হয় ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। তবে বাংলা, ইংরেজি প্রথম পত্র, গণিত, রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞানসহ বিষয়ের প্রশ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ সত্ত্বেও এসব পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি।
২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষায়ও একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস ঘটতে থাকে। ২০১৪ সালে সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে ধুমধামের সাথ।
২০১৩ সালে সমাপনী পরীক্ষায় ইংরেজি এবং বাংলা বিষয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্তে প্রমাণিত হয়। ইংরেজি ৮০ এবং বাংলা ৫৩ শতাংশ প্রশ্ন মিলে যায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে। তবু এ পরীক্ষা বাতিল হয়নি। প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এস এম আশরাফুল ইসলাম তখন জানান তদন্তে প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রমাণিত হয়েছে। তবে পরীা বাতিল করা হচ্ছে না।
২০১২ সালেও সমাপনী পরীক্ষায় বাংলা ও গণিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে।
২০১৪ সালে সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন জেলায় দায়ীদের শাস্তি দিয়েছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে সোচ্চার অনেকে অনলাইনে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তাদের কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু তারপরও প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার গত ৪ ডিসেম্বর নেত্রকোনা কেন্দুয়ায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেলেও এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০১৩ সালের এসএসসি ও সমানের পরীায়ও সব প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। গণিত, ইংরেজি প্রথম পত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
এ ছাড়া ২০১৩ সালে ৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীায় ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, হিসাববিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিা অধিদফতর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
নিয়োগ পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস এমন মহামারী আকার ধারণ করেছে যে, সরকারি সর্বোচ্চ নিয়োগ পরীক্ষা তথা বিসিএস পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পরীক্ষা স্থগিতের ঘটনা ঘটল। ২০০৯ সাল থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক নিয়োগ, বিসিএস, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা, অডিট, এনবিআর, থানা ও উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও), মেডিক্যাল, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ও অভিযোগ উঠেছে। ইসলামী ব্যাংকেরও নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে ২০১২ সালে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের ভিত্তিতে স্থগিত করা হয় ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীা ও অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীা। একই কারণে প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক নিয়োগের পরীক্ষাও ১৭ জেলার বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩৪তম বিসিএসের লিখিত পরীার প্রশ্ন ফাঁসেরও অভিযোগ রয়েছে।
২০১৩ সালের ৩১ মে ফাঁস হয়ে যায় অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার নিয়োগ পরীার প্রশ্ন। ওই দিন বিকেল ৪টায় পরীা থাকলেও সকাল ৯টা থেকেই হাতে লেখা প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সত্যতা পাওয়ার পর ১২ জুন ওই পরীা বাতিল করা হয়।
২০১০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক নিয়োগ পরীার প্রশ্ন ফাঁস হয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীা হলেও পরীা বাতিল হয়নি। একই বছর ২৮ আগস্ট উপজেলা প্রাথমিক শিাকর্মকর্তা নিয়োগের লিখিত পরীার প্রশ্ন ফাঁস হয়। একই বছর ৮ জুলাই সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী নিয়োগ পরীার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় পরীা স্থগিত করা হয়। একই বছর ১৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কর্মকর্তা পদে নিয়োগের লিখিত পরীার প্রশ্ন ফাঁস হয়। এতে ওই পরীা বাতিল করে কর্তৃপ।
২০১১ সালে অডিট বিভাগের নিয়োগ পরীার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ২০১২ সালের ২৭ জানুয়ারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই খাদ্য অধিদফতরের নিয়োগ পরীা নেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ওই পরীা বাতিল করা হয়। ২৭ জুলাই জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীার আগের রাতে পুরান ঢাকার একটি হোটেল থেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নসহ ১৬ জনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১২ বছরের ৩ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদে নিয়োগের বাছাই পরীার প্রশ্ন ফাঁস হয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে পরীায় হলের প্রশ্নের হুবহু মিল থাকলেও পরীা বাতিল বা তদন্ত হয়নি। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই এটিইও পদে প্রিলিমিনারি পরীা হয়। ২০১২ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীার প্রশ্ন ফাঁস হয়। এ ঘটনায় ৬ অক্টোবর পিএসসি পরীা স্থগিত করে। ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর প্রাইমারি স্কুলে প্রধান শিক নিয়োগ পরীার প্রশ্নপত্র ফাঁসেরও অভিযোগ ওঠে।
ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে গড়ে উঠছে জালিয়াতচক্র। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ চক্র প্রশ্ন ফাঁসসহ উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পরীক্ষার হলে বাইরে থেকে উত্তর বলে দেয়ার কৌশল রপ্ত করে ভর্তি ইচ্ছুকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বড় অঙ্কের অর্থ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ চক্রের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে ইতোমধ্যে। ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এ চক্র প্রযুক্তির সাহায্যে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়।
বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আন্দোলন করছে মেডিক্যালে ভর্তি ইচ্ছুকরা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে তারা পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। এর আগেও ২০১০-১১ সালে মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। সে বছর ৩০ সেপ্টেম্বর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সিন্ডিকেট চক্রের ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ৫২টির মধ্যে ৪১টি প্রশ্ন মিলে যায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে।
প্রশ্ন ফাঁসের রেকর্ড
ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে গত ছয় বছরে । ১৯৭৯ সালে এসএসসি পরীায় সর্বপ্রথম প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ১৯৭৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ২৯ বছরে ৫৫টি পরীার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। আর গত ছয় বছরে ৩০টিরও বেশি পরীার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।
প্রশ্ন ফাঁস, মামলা ও তদন্ত
বিভিন্ন পরীায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গত ছয় বছরে রাজধানীতে ৭০টি মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলায় শাস্তি পাওয়ার তেমন নজির নেই। অনেকে প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়েছে। অনেক মামলা আর সচল নেই। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় অনেক তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্তে অনেক ঘটনা প্রমাণ হয়েছে। তদন্তে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে অনেক সুপারিশও করা হয়েছে। কিন্তু তারও তেমন কোনো বাস্তবায়ন নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রকাশিত একটি তথ্যে দেখা যায়, গত ৩৫ বছরে অন্তত ৭৮টি পরীার প্রশ্ন ফাঁস হলেও তদন্ত কমিটি হয়েছে ২৩টিতে। আর বাতিল ও স্থগিতের ঘটনা ঘটেছে ১২টির মতো পরীক্ষায় ।
বার্ষিক পরীায়ও প্রশ্ন ফাঁস!
কুড়িগ্রামের চিলমারি উপজেলায় গত বছর ডিসেম্বর মাসে মাধ্যমিক স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ১ ডিসেম্বর উপজেলার সব উচ্চবিদ্যালয়ে চারটি সেটের মাধ্যমে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে বার্ষিক পরীা শুরু হওয়ার পর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে বিভিন্ন স্কুলে।
টিআইবির অনুসন্ধান
গত ৫ আগস্ট রাজধানীতে টিআইবির প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন পাবলিক পরীায় ৪০টি ধাপে প্রশ্ন ফাঁস হয়। তার মধ্যে ২৩টি ধাপ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, বিজি প্রেসে কম্পোজ, প্রুফ দেখা, সিলগালা করা ও বিতরণ এবং পরীার দিন পরীা কেন্দ্রে শিকদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে শিাবোর্ড, মাধ্যমিক শিা অধিদফতর, প্রাথমিক শিা একাডেমি, কোচিং সেন্টার, গাইড বই ব্যবসায়ী ও সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন সরাসরি জড়িত। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে আকারভেদে ২০ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থের লেনদেন হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক শিা সমাপনী (পিইসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) এবং উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) এ চারটি পাবলিক পরীার প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন, ছাপানো, সংরণ ও বিতরণের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এ গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৯ সালে প্রশ্ন ফাঁসের প্রবণতা শুরু হলেও ২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৪ শিাবর্ষ সব বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। গত চার বছরে গবেষণার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন পাবলিক পরীায় ৬৩টি প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ওয়েবসাইট, মোবাইল ও আত্মীয়স্বজন এ চারটি মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের হাতে পৌঁছায়।
গবেষণার সার্বিক পর্যবেণে দেখা যায়, প্রশ্ন ফাঁসের সাথে সরকারি ও বেসরকারি উভয় অংশীজন জড়িত। প্রশ্ন প্রণয়ন, ছাপানো ও বিতরণে এবং তদারকির সাথে সম্পৃক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত। প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, প্রশ্ন প্রণয়নের দীর্ঘ প্রক্রিয়া, ম্যানুয়াল পদ্ধতির সাথে অনেকের সম্পৃক্ততাও প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
প্রতিবেদনের সারমর্ম তুলে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথাকথিত সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখা ও প্রশ্নপত্র দিয়ে শিার্থীদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টিকে অস্বীকার করার প্রবণতা, বিষয়টি ‘সাজেশন কমন পড়া’, ‘গুজব’ বলে অস্বীকার করা, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করা, প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া এবং ঘটনার পুনরাবৃত্তি নীতি। এ ছাড়া পাবলিক পরীা অপরাধ আইনে শাস্তি কমানো, কোচিং বাণিজ্যে বন্ধে প্রণীত নীতিমালা অস্পষ্টতা, গাইড বই বন্ধে আইনের শিথিলতা, বিভিন্ন সময় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ না করা, প্রশ্ন ফাঁসের সাথে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া, একই শিক প্রতিবছরই প্রশ্ন প্রণেতা হিসেবে নিয়োগ, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর তদারকি ও প্রয়োজনীয় পদেেপর ঘাটতি, পরিবর্তিত শিা ও পরীা কাঠামোর ওপর শিকদের যথাযথ ও পর্যাপ্ত প্রশিণের অভাব, বিজি প্রেসে পর্যাপ্ত তদারকি ও নিরাপত্তা না থাকা, শিাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বিকল্প প্রশ্ন না থাকা, প্রশ্ন গণনায় ম্যানুয়ালি করা, সচেতনতার ঘাটতি। এর ফলে সার্বিক শিা কাঠামোতে নৈতিকতার অবয়, শিার গুণগতমানের অবনতি পরিলতি হচ্ছে। একে শিার্থীদের মাঝে পড়াশোনার ঘাটতি, মেধাবীদের তুলনায় রেজাল্টে কম মেধাবীরা এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতায় ল্য করা গেছে।
নৈতিকতার বিপর্যয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর এমিরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রশ্ন ফাঁস ঘটনার সাথে আমাদের সমাজের অনৈতিকতার বিপর্যয়ের চিত্রও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সমাজে অনৈতিকতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মা-বাবাও দৌড়াচ্ছেন সন্তানের জন্য ফাঁস হওয়া প্রশ্ন জোগাড় করার জন্য। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন জোগাড় করে দেয়ার জন্য। মা-বাবা সে আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন। কারণ প্রশ্ন জোগাড় করতে না পারলে তার সন্তানতো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। একেবারে কোমল অবস্থায়ই একজন শিশুকে অনৈতিকতার দিকে ধাবিত করা হচ্ছে । মা-বাবা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী মিলে সবাই অনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই যে চিত্র এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক জাতির জন্য।
প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। গত ২৭ নভেম্বর অনলাইন পোর্টাল বিডিনিউজটুয়েন্টিফোরডটকম-এ তিনি লিখেছেন ‘ছোট ছোট শিশুদের অন্যায় করতে শেখানো হচ্ছে। সারা পৃথিবীর কোথাও এই নজির নেই, যেখানে একটি রাষ্ট্র তার দেশের শিশুদের অন্যায় করতে শেখায়। একটা দেশের মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙে দেয়ার কি এর চেয়ে পরিপূর্ণ কোনো পদ্ধতি আছে? নেই। সারা পৃথিবীতে কখনও ছিল না, ভবিষ্যতেও কখনও থাকবে না। শুধু আমাদের দেশেই কিছু আমলা আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ একটা শিাব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করার একটি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। যে জাতি শৈশবে অন্যায় করতে শিখে বড় হয়, সেই জাতি দিয়ে আমরা কী করব?’
জাফর ইকবাল লিখেছেন ‘এই দেশের শিাব্যবস্থার হর্তাকর্তা বিধাতারা, আপনাদের কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করি, আমাদের দেশের শিশুদের আপনারা মুক্তি দিন। এই শিশুগুলো যদি কোনো পরীা না দিয়ে শুধু বইগুলো নাড়াচাড়া করে সময় কাটিয়ে দিত তাহলে অন্তত তাদের একটা সুন্দর শৈশব থাকত, তারা অন্তত অন্যায় করা শিখত না। আমাদের শিশুদের লেখাপড়ার দরকার নেই, দোহাই আপনাদের, তাদের ক্রিমিনাল করে বড় করবেন না! ’
হতাশায় মেধাবীরা
‘প্রশ্ন যদি হবে ফাঁস পড়ব কেন বার মাস’ স্লোগান ধারণ করে বর্তমানে আন্দোলন করছেন মেডিক্যাল ভর্তি ইচ্ছুকরা। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে অনেক অমেধাবী যেমন পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করছে তেমনি অনেক অমেধাবীরা ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারছে। আবার অনেক অযোগ্যরা পাচ্ছে ভালো চাকরি। না পড়েই যদি প্রশ্ন ফাঁসের কারণে এসব পাওয়া যায় তাহলে মেধাবীরা ১২ মাস কষ্ট করে কেন পড়বে এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই জাতির কাছে। এ প্রশ্ন সত্যিই অনেক বেদনার অনেকের কাছে।
রাজধানীর হলিক্রস কলেজের অভিভাবক সালমা নাজু জানান, এইচএসসি পরীক্ষার সময় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় তার মেয়ে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে। এ কলেজের মেয়েরা সবাই পড়াশুনায় ভালো। কিন্তু পরীক্ষার সময় ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে অন্যদের কাড়াকাড়ির দৃশ্য দেখে তার মেয়েসহ অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা কান্না ধরে রাখতে পারেনি। সারা বছর এত কষ্ট সাধনার পর এখন সবাই পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পেয়ে যাচ্ছে এবং পরীক্ষার খাতায় তা গড় গড় করে লিখে দিয়ে আসছে। সালমা নাজু জানান, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় পরীক্ষার সময় সে এবং তার মেয়ে যে মানসিক কষ্ট পেয়েছেন তা কোনো দিন ভুলতে পারবেন না।
প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলার সময় তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, হতাশা এবং বেদনার চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ভেঙে পড়েছেন অসংখ্য মেধাবী ছাত্রছাত্রী, চাকরিপ্রার্থী এবং তাদের মা-বাবা। রাজধানীর বিভিন্ন নামকরা কলেজের এইচএসসি পড়–য়া শিক্ষার্থীরা আগের বছরগুলোতে প্রশ্ন ফাঁসের স্মৃতিচারণ করে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, তারা দেখেছে কিভাবে তাদের সামনে অমেধাবীরা, যারা হয়তো ঠিকমতো পাসই করতে পারত না তারাও জিপিএ ৫ পেয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে ফল প্রকাশের পর। তাদের মতে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা এবং উদারনীতিতে খাতা মূল্যায়নের কারণে ভালোমন্দ সব একাকার হয়ে গেছে। সারা বছর তাদের পরিশ্রম মূল্যহীন হয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.