সিজার হত্যা রহস্যের জট খোলেনি ৫ দিনেও

রাজধানী ঢাকায় ইতালিয়ান নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জট খুলতে পারেনি পুলিশ। কারা কেন তাকে হত্যা করলো পুলিশ তা জানতে পারেনি। জানা যায়নি হত্যাকাণ্ডের কারণও। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে হত্যা রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করছেন। খুনিদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করতে সব ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন। এজন্য কিছু সময় লাগবে। এদিকে ইতালিয়ান নাগরিক হত্যা রহস্যের জট না খুলতেই উত্তরাঞ্চলীয় বিভাগীয় শহর রংপুরে জাপানের এক নাগরিককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দুই হত্যাকাণ্ডের ধরন একই। উদ্দেশ্যও একই বলে ধারণা করছেন তারা। এ কারণে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। গতকাল বিকালে পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। পরে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে সারাদেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে বিশেষ নির্দেশনাও পাঠানো হয়েছে। ইতালিয়ান নাগরিক তাভেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাভেলার খুনিদের ধরতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করছেন তারা। হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্ধারে মরিয়া হয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কাজ করছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ৬ জন সহকারী পুলিশ কমিশনারের (এসি) দল হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য নানা কারণ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। প্রযুক্তির পাশাপাশি কাজে লাগানো হচ্ছে গুপ্তচরদের। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা পেশাদার কিলার গ্রুপের সদস্যদের তালিকা করেছে। তাভেলা সিজারকে ভাড়াটে কিলাররা খুন করতে পারে- এই ধারণা থেকে তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর করা হচ্ছে। খোঁজ নেয়া হচ্ছে অস্ত্রের উৎসের বিষয়েও। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দেশী-বিদেশী কোন চক্র এ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে গোয়েন্দারা ধারণা করছেন। রংপুরে জাপানি নাগরিককে একই কায়দায় হত্যার পর এ সন্দেহ আরও জোরালো হয়েছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের। এ কারণে এই বিষয়টিতেই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াও গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে তৃতীয় কোন পক্ষ তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে এ কাজ করেছে কিনা তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, এই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি জোর দিয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, দেশীয় কোন জঙ্গি গ্রুপ কৌশল বদলে বিদেশী নাগরিকদের হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নামতে পারে। যাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আলোচনায় আসে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তাভেলা সিজার খুন হওয়ার পরপরই এরকম আরও ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছিলেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ কারণে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া রাজধানীর আট ক্রাইম জোনের উপ-পুলিশ কমিশনাদের নিজ কার্যালয়ে ডেকে সতর্কতামূলক বিভিন্ন নির্দেশনা দেন।
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, ইতালিয়ান নাগরিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক চাপে রয়েছেন তারা। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্লু পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। তবে উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে ঘটনাস্থলের আশপাশের মোবাইলের কললিস্ট, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে খুনিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
ইতালিয়ান নাগরিক হত্যকাণ্ডের রহস্য জট খোলার আগেই গতকাল সকালে রংপুরে আরেক বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন আইজিপি একেএম শহীদুল হক। গতকাল বিকালে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে আইজিপি দুই বিদেশী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শক্ত হাতে দমন করার নির্দেশ দেন। এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ আগে যেভাবে অপরাধীদের দমন করেছে সেভাবেই বিদেশী নাগরিকদের খুনিদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করবে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বৈঠকে রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিকপাড়াসহ সারাদেশে বিদেশী নাগরিকদের আবাস ও কর্মস্থলে নিরাপত্তা জোরদার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধির জন্য নির্দেশনা দেন। বৈঠক শেষে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা মেট্রোপলিটন এলাকাসহ সারাদেশের এসপিদের কাছেও পাঠানো হয়।
দুই হত্যা একই সূত্রে গাঁথা: ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার এবং জাপানের নাগরিক হোসি কনিও হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন পুলিশ ও র‌্যাবসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, তাভেলা সিজারের খুনের ধরনের সঙ্গে হোসি কোনিও হত্যার ধরনে মিল রয়েছে। একইভাবে গুলি করে হত্যার পর দুর্বৃত্তরা অপেক্ষমাণ মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যেই দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনাকে কোন মহলের বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে দেখছেন গোয়েন্দারা। হত্যাকাণ্ড দুটির ধরন ও উদ্দেশ্য একই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডে একইভাবে মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়েছে। গুলি করে খুনিরা একইভাবে পালিয়ে যায়। নিহত দুইজনের শরীরেই তিনটি করে গুলি করা হয়েছে। দুটি হত্যাকাণ্ডেই মোটরসাইকেলে করে দুইজন খুনি এলেও আশপাশে আরও কয়েকজন অবস্থান করছিল। নিহত দুই বিদেশী নাগরিকের কাছ থেকে টাকা কিংবা মালামাল কোন কিছুই খোয়া যায়নি। পরিকল্পিতভাবে হত্যার জন্যই খুনিরা এসেছিল। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইতালির নাগরিক সিজার এবং জাপানের নাগরিক হোসি কোনিও হত্যার ধরন প্রায় একই রকম। দুটি ঘটনার মোটিভও একই রকম বলে মনে হচ্ছে। এক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্র থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। র‌্যাবের এই গোয়েন্দা প্রধান আরও বলেন, হোসি কোনিও ৬৬ বছরের একজন বয়স্ক নাগরিক। তিনি রংপুরে বসবাস করে নানা কৃষি কর্মকাণ্ডে সময় পার করেন। তার এখানে খুন হওয়ার মতো শত্রু থাকার কথা নয়। একইভাবে তাভেলা সিজারও দরিদ্র বাংলাদেশীদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে কাজ করছিলেন। ফলে এ দুই হত্যাকাণ্ড কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে ঘটানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.