এবার জাপানি নাগরিক হত্যা, আইএসের টুইটে হত্যার দাবি by আরিফুল হক

জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি। রংপুর মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালে তাঁর লাশ (ডানে ওপরে) এবং
রংপুরের আলুটারি গ্রামে হত্যাকাণ্ডের স্থান থেকে
গতকাল আলামত সংগ্রহ করে পুলিশl -প্রথম আলো
ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যার রেশ কাটতে না-কাটতেই রংপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হলেন জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি। রংপুর শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আলুটারি গ্রামে গতকাল শনিবার এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ এ ঘটনায় চার ব্যক্তিকে আটক করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) টুইট করে দাবি করেছে, তারা এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। একই সঙ্গে এ ধরনের আরও হামলার হুমকি দিয়েছে সংগঠনটি।
এ ঘটনার তদন্তে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন রংপুরের পুলিশ সুপার এবং র্যা ব, সিআইডি ও পিবিআইয়ের তিন কর্মকর্তা।
গত সোমবার রাজধানীর গুলশানে কূটনৈতিক পাড়ায় খুন হন সিজার তাবেলা, যার এখনো কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এর চার দিন পরে রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে দিনদুপুরে একই কায়দায় দুর্বৃত্তরা খুন করল জাপানের নাগরিক কুনিও হোশিকে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, আইএস কুনিও হত্যার দাবি করে নিজেদের টুইটার অ্যাকাউন্টে টুইট করেছে। সিজার তাবেলা হত্যার দাবিও করেছিল সংগঠনটি। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ দাবি নাকচ করে দেয়। আর কুনিও হত্যার ঘটনায় আইএসের দাবির বিষয়ে জানতে গত রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, কুনিও হোশি (৬৬) গত ৮ আগস্ট ভারত থেকে বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আসেন। আগামী বছরের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর ভিসার মেয়াদ ছিল। তিনি রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় এ কে এম জাকারিয়া নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।
বাড়িমালিক জাকারিয়া বলেন, ‘আলুটারি গ্রামে কুনিওর একটি প্রকল্প আছে। শুনেছি, সেখানে তিনি একধরনের ঘাসের আবাদ করতেন। প্রতিদিনের মতো আজ (গতকাল) সকালে তিনি কাজে বের হন। এর বেশি কিছু জানি না। পরে তাঁর মৃত্যুর খবর লোকমুখে শুনে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই।’ এ ঘটনায় পুলিশ জাকারিয়াকে আটক করেছে।
জাকারিয়া নিজেও দীর্ঘদিন জাপানে ছিলেন। তাঁর পরিবারের অনেকে এখনো জাপানে থাকেন। এই সূত্রে কুনিও বাংলাদেশে তাঁর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। রিকশাচালক মুন্নাফ হোসেন প্রতিদিন কুনিওকে খামারে নিয়ে যেতেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এস এম বরকতুল্লাহ বলেন, হাসপাতালে ভর্তির আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর বুকে, গলার বাঁয়ে এবং ডান হাতের কবজিতে গুলির চিহ্ন রয়েছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ এবং সরেজমিনে জানা গেছে, শহরের মাহিগঞ্জ থেকে হারাগাছের দিকে পাকা রাস্তা ধরে এগোলে এক কিলোমিটার পর ডান দিকে নেমে গেছে কাঁচা রাস্তা। পাকা রাস্তা থেকে আলুটারি গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে ১০০ গজ এগোলেই খোকা মিয়ার বাড়ি। এই বাড়ির ৩০০ গজের মধ্যে আর কোনো বাড়ি নেই। শুধুই সবুজ ধানখেত।
আনুমানিক সকাল ১০টা। মুখে কালো কাপড় বাঁধা দুই যুবক খোকা মিয়ার বাড়ির সামনে এসে রিকশার গতিরোধ করেন। রিকশায় ছিলেন কুনিও হোশি। তাঁকে গুলি করে পাকা রাস্তার দিকে দৌড়ে যান ওই দুই যুবক। পাকা রাস্তায় আগে থেকেই হেলমেট পরে অপর এক যুবক মোটরসাইকেল চালু করে বসে ছিলেন। দুজন উঠতেই মোটরসাইকেল চলে যায় হারাগাছের দিকে। যুবকদের পরনে হাফ শার্ট ও জিনসের প্যান্ট ছিল।
ঘটনাস্থলের ৩০০ গজের মধ্যে পাকা সড়কে কয়েকটি চায়ের স্টল ও ছোট বাজার আছে। গুলির শব্দ শুনে সেখান থেকে লোকজন ছুটে এসে কুনিওকে দ্রুত একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় শহরের মাহিগঞ্জ সাতমাথা এলাকায় নিয়ে যান। এরপর সেখান থেকে একটি পিকআপ ভ্যানে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনাস্থল আলুটারি এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘কলেজে যাওয়ার জন্য আমি অটোরিকশার অপেক্ষায় ছিলাম। আনুমানিক ১০টার সময় পরপর কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপর চিৎকার। এগিয়ে আসতেই দেখি, লাল রঙের একটি মোটরসাইকেলে তিন যুবক হারাগাছের দিকে দ্রুত চলে যাচ্ছে। চালকের মাথায় হেলমেট ছিল। মোটরসাইকেলের পেছনে নম্বর ছিল না। লেখা ছিল প্রেস।’
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় গুলিতে নিহত
জাপানের নাগরিক কুনিও হোশির চাষ করা
ঘাসের নমুনা সংগ্রহ করে আনছেন
সাদাপোশাকের এক পুলিশ সদস্য। -প্রথম আলো
পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহত জাপানি ব্যক্তির বুকে একটি গুলি, বাঁ ঘাড়ে একটি গুলি, ডান হাতের কবজিতে একটি গুলিসহ মোট তিনটি গুলি করা হয়েছে।
কুনিও হোশি আলুটারি গ্রামের বাসিন্দা শাহ আলমের কাছ থেকে ১৮ হাজার টাকার বিনিময়ে দুই একর জমি লিজ নিয়েছিলেন। জমিতে গত চার মাসে শুধু ঘাস আবাদ করতে দেখেছেন শাহ আলম। তিনি বলেন, কুনিও খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। সবার সঙ্গে মিশতেন। তাঁর কোনো শত্রু থাকতে পারে না। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রংপুরের দায়িত্বে নিয়োজিত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুস সালাম ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি পুরোপুরি তদন্ত না করে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে যেখানে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সে স্থানটি ঘিরে রাখা হয়েছে। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এখানে আন্তর্জাতিক বিষয় জড়িত। বিষয়টি উদ্ঘাটনে যত প্রযুক্তি আছে, সবই প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাক বলেন, এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির মালিক এ কে এম জাকারিয়া, রিকশাচালক মুন্নাফ, যে বাড়ির সামনে ঘটনা ঘটেছে, ওই বাড়ির এক যুবক মুরাদ ও হিরা নামে কুনিওর সঙ্গে সব সময় মিশতেন এমন একজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
জাপানি নাগরিককে হত্যার ঘটনার পর গতকাল রংপুর বিএনপি ও যুবদলের দুই নেতাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তাঁদের পরিবার। তাঁরা দুজন হলেন মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী ওরফে বিপ্লব ও জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান ওরফে লাকু। রাশেদ-উন-নবী বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিব-উন-নবী সোহেলের ছোট ভাই। বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তবে পুলিশ বলেছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানে না।

No comments

Powered by Blogger.