সরকার, দল ও জোটে অস্বস্তি

ইতালির নাগরিকের পর এবার দুর্বৃত্তদের গুলিতে
নিহত হলেন জাপানের এক নাগরিক হোসি কোনিও
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার দিন দল ও জোট যখন সংবর্ধনার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখন রংপুরে জাপানি নাগরিককে হত্যার ঘটনায় অবাক হয়েছেন নেতা-কর্মীরা। সরকার, সরকারের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলে এ ঘটনায় অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
এ ঘটনা যে পরিকল্পিত তা নিয়ে সংশয় না থাকলেও এর নেপথ্য কারণ নিয়ে নানামুখী জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে। বিশেষ করে দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির সময় কাছে আসায় দেশ অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বলে সরকারের একটি বড় অংশের মত।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় ইতালীয় নাগরিককে হত্যার চার দিন পর রংপুরে একই কায়দায় জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভেতর দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি।
দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও বিশিষ্ট নাগরিককে বলেছেন, তাঁর সঙ্গে যে কজন বিশ্বনেতার বৈঠক হয়েছে, তাঁরা দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন। এই সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে তিনি যখন সর্বশক্তি নিয়োগ করছেন, তখন এ ধরনের চক্রান্তে তা নস্যাৎ হতে দেওয়া হবে না।
একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী এ সময় বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও শান্ত। ঠিক এ সময় দুজন বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে সরকারকে বিব্রত করার জন্য। এটা সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং গভীর ষড়যন্ত্র।
বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের না আসা, দুই বিদেশিকে হত্যা ও বিভিন্ন দেশের ভ্রমণবিষয়ক সতর্কবার্তা জারির পর যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, বাংলাদেশ কি এতই অনিরাপদ যে মানুষ এখানে আসতে পারবে না? হয়তো এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে আমাদের সবার সামনে।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, ‘ইতালীয় ও জাপানি নাগরিকের হত্যার পর ঘটনা দুটোকে যুক্ত করে দেখলে বোঝা যায়, আবার দুটি ফাঁসির রায় হবে এবং আরও কিছু ঘটনাবলি হয়তো আমাদের সামনে রয়েছে।’
সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত একাধিক শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতা একবাক্যে বলছেন, দুটি ঘটনাই পূর্বপরিকল্পিত। কিন্তু উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর বাতিল করায় ক্রিকেটে যে ধারাবাহিক ও ঈর্ষণীয় অর্জন তা ম্লান করার অপচেষ্টা লক্ষ করছেন তাঁরা। তবে দুই বিদেশিকে হত্যার পর সরকারদলীয় নেতাদের ধারণা, এটি শুধুই আর ক্রিকেট রাজনীতি নয়, এর সঙ্গে আরও বড় চক্রান্ত জড়িত।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি নাগরিক হত্যা করার বিষয়টি দেশের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এসব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে সরকারের সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল শনিবার ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলেননি। তবে গণভবনে পৌঁছানোর পর বিশিষ্ট নাগরিক, দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কিছু কথা বলেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার নিশ্চয়তা দেন। এ বিষয়ে সৈয়দ শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ড কারা ঘটাচ্ছে, তা গোয়েন্দারা খুঁজে বের করবে এবং তাদের সেই দক্ষতা আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মন্ত্রী জানান, আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তিসহ সফর নিয়ে কথা বললেও দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির বিষয়টিও উঠে আসে। একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী এ সময় বলেন, সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য বিদেশিদের নিশানা করা হয়েছে। বিশেষ করে দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির ক্ষণ ঘনিয়ে আসায় ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় জ্যেষ্ঠ নেতারা বলেন, বিদেশিদের নিশানা করা হয়েছে দেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারের জন্য। কারণ বিদেশিদের হত্যা করা হলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও তা বড় খবর।
আরেকজন মন্ত্রী বলেন, নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশে আসা নিয়ে কিছু বিদেশি দূতাবাস বক্তব্য দেওয়ার পর থেকেই দুটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। বিদেশি দূতাবাসগুলোর উদ্বেগ প্রকাশ করার পর ষড়যন্ত্রকারীরা আরও সক্রিয় হয়েছে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী যেকোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরকার সতর্ক রয়েছে বলে জানান। আলোচনার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী আজ রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশ সফরের অর্জন ও প্রাপ্তি ছাড়াও দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডসহ দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলবেন বলে ধারণা করা যায়। তিনি বলেন, সরকার মনে করছে, এটা কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, উদ্দেশ্যমূলক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
সরকারদলীয় নেতারা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন উপলক্ষে এবং ওই নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে যে অস্থিরতা ও সহিংসতা ঘটিয়েছিল, সেই শক্তি দল দুটির নেই। ফলে সরকার অনেকটা নির্বিঘ্নে দেশ চালাচ্ছিল। এরই মধ্যে বিদেশি নাগরিক হত্যার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি চক্র নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘৫ জানুয়ারির পর আমরা আশা করেছিলাম একটা সময়কাল আমরা অতিক্রম করেছি। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে প্রক্রিয়া সেটাও অনেকখানি সম্পন্ন হয়েছে নির্বিঘ্নভাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবার সেই অস্থিরতার অধ্যায় ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টা লক্ষণীয়।’
এদিকে লন্ডন থেকে প্রধানমন্ত্রী প্রথমে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে নামার পর সেখানে স্থানীয় তিন সাংসদসহ জেলা ও মহানগরের আট নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া দুজন নেতা প্রথম আলোকে জানান, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য কুচক্রীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে—এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী নেতাদের সজাগ ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

No comments

Powered by Blogger.