ইটভাটায় পুড়ছে শিশুদের স্বপ্ন by মো. মিজানুর রহমান দুলাল

ইটভাটায় শিশু শ্রমিকরা (ফাইল ছবি)
হাতীবান্ধার উত্তর সিঙ্গীমারী গ্রামের আব্বাস আলী। স্ত্রী আর তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে ৬ মাসের জন্য যাচ্ছেন নরসিংদীর ইট ভাটার শ্রমিক হিসেবে। এতে করে সংসারের আয় রোজগার বাড়লেও ইটভাটায় চাপা পড়ছে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা জীবন। শুধু আব্বাস আলীই নন উপজেলার হাজার হাজার পরিবার প্রায় প্রতিদিনই তাদের শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইটভাটায় পাড়ি জমাচ্ছে স্থানীয় বড়খাতা রেলগেট এলাকা থেকে। সেখানে দূরপাল্লার বাসে করে তাদের চলে যাওয়ার দৃশ্য সবাই দেখলেও শুধু চোখে পড়ছে না সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বিভাগের। ফলে প্রতিবছর অঙ্কুরেই ঝড়ে যাচ্ছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ১২ বছর বয়সের শিশু মিলন ও তার ছোট ভাই জুয়েল (১০) বাবা-মায়ের সঙ্গে ইটভাটায় যাচ্ছে। কথা হলে ওই দুই সহোদর জানায়, এর আগেও তারা দুই ভাই ৬ মাসের জন্য ইটভাটায় যায়। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে পড়াশোনায় আর মন বসেনি তাদের। ফলে মিলন পঞ্চম আর জুয়েল চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে বিদ্যালয়ের পাঠ ইতি টেনেছে। তবে এ বছর ইটভাটায় গমনে নতুন সদস্য হিসেবে যোগ হয়েছে তাদের ছোট্ট ভাই শুভ (৮)। শুভ স্থানীয় এক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। জানতে চাইলে ওই তিন শিশুর বাবা আব্বাস আলী বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ৫ জনের সংসার চলে না বলেই সর্দারের কাছে থেকে ৪০ হাজার টাকা অগ্রিম নিয়েছি। নরসিংদীতে ৬ মাস ইট তৈরি করে ওই টাকা শোধ করে আরও কিছু টাকা আয় করার জন্যই সেখানে যাচ্ছি।’ কিন্তু এতে করে আপনার সন্তানরা তো শিক্ষা জীবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে- এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে না পেরে বাসে উঠে পড়েন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা, কাকিনা, আদিতমারী, বাউরা এলাকা থেকে অভাবের তাড়নায় নিু আয়ের পরিবারগুলো সপরিবারে ইটভাটায় যায়। এসব পরিবার তাদের জীবন বাঁচাতে ইটভাটায় নিয়োজিত সর্দারের নিকট থেকে আগাম টাকাও নিয়ে থাকেন। যার পরিমাণ জনপ্রতি প্রায় ১৫ হাজার টাকা। আবার গ্রুপভিত্তিক ৮০ থেকে ১ লাখ টাকাও অগ্রিম নেয়া হয় বলেও জানা গেছে। ইটভাটায় কাজে যাওয়া ওইসব মানুষজন জানিয়েছেন, একটি ইট তৈরিতে প্রায় চার জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এতে প্রথম জন কাঁদামাটি সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় জন ওই কাঁদামাটি সারি সারি করে মাঠে ফেলেন। তৃতীয় জন তা একটি ইটের পরিমাণ মুষ্ঠি করে দেন। আর চতুর্থ জন ফর্মা (ইট তৈরিতে কাঠের যন্ত্র) দিয়ে পরিপূর্ণ কাঁচা ইট প্রস্তুত করে থাকেন। এভাবে চার জন মিলে দৈনিক ৪-৫ হাজার ইট তৈরি করতে পারেন। ফলে চার সদস্যের একটি পরিবার প্রতিদিন এক হাজারেরও অধিক টাকা আয় করতে পারেন। সে কারণেই লালমনিরহাটের বিভিন্ন এলাকার শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন তাদের শিশু শিক্ষার্থীসহ নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার ইটভাটাগুলোতে সপরিবারে পাড়ি জমাচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এদিকে হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা, ফকিরপাড়া, গড্ডিমারী, সানিয়াজান ও সিংঙ্গীমারী ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, ওই সব এলাকা থেকে এ বছর সর্বোচ্চ সংখ্যক লোক ইটভাটায় যাচ্ছেন। ফলে ওই সব এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশু শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে এসেছে। কিন্তু কোন স্কুলে কতজন ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত রয়েছেন সে ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তবে স্থানীয়রা বলছেন, যেসব পরিবার ইটভাটায় যাচ্ছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ৮ থেকে ১২ বছরের শিশু রয়েছে। এসব শিশু বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেও বলে জানান এলাকাবাসী। বড়খাতা ইউপি সদস্য আবেদ আলীর ভাষ্য মতে, উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার নারী ও পুরুষ ইটভাটার কাজে রয়েছে। এরা ৬ মাস পর এলাকায় ফিরবেন। রোববার দুপুরে এ ব্যাপারে জানতে হাতীবান্ধা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হাসান আতিকুর রহমানের মুঠো ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, তিনি কয়েক দিন ধরে অফিসে আসছেন না।

No comments

Powered by Blogger.