সস্তা দরে রফতানির তেলেসমাতি

উৎপাদিত পণ্যের কাক্সিক্ষত দাম যায় না কৃষকের পকেটে। এ কারণে কয়েক হাত বদল হওয়ার পরও দেশের যে কোনো কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রফতানি মূল্য আমদানিকারক দেশের স্থানীয় দাম অপেক্ষা কম বলে বিবেচিত হচ্ছে। আমদানিকারক দেশের ভাষায় এটি পরিষ্কার ডাম্পিং। ইতিমধ্যে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশকে এ পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে কম দরের অভিযোগে ইরান, মিসর ও ব্রাজিলের মতো বড় বাজারে অ্যান্টি ডাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়তে হয়েছে। এবার আরেক শীর্ষ আমদানিকারক ভারতের বাজারেও সেই একই ফাঁদে পড়ার উপক্রম হয়েছে বাংলাদেশী পাট পণ্যের। সম্প্রতি দেশটি ডাম্পিংয়ের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি বাধাগ্রস্ত করতে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এখন এ পণ্য আমদানির ওপর কি পরিমাণ অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক বসানো যায়, বসালে এর আর্থিক পরিমাণ কেমন হবে, এর প্রভাবই কতটা পড়বে- তা যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এ পাট ভর্তুকি মূল্যে ভারতে রফতানি হচ্ছে কিনা, তা খুঁজে বের করতে তদন্তও শুরু করেছে দেশটি। যদিও এ ব্যাপারে ভারতের কাছে প্রাথমিকভাবে এ ধরনের পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে বলে দাবিও করা হয়েছে। এখন তার উপরই চলছে অধিকতর তদন্তের কাজ। শেষ পর্যন্ত ডাম্পিংয়ের এ অভিযোগ ভারত সরকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে প্রমাণ করতে পারলে বাংলাদেশের পাট পণ্য রফতানির ওপর তারা এ অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক বসানোর মতো কঠোর সিদ্ধান্তে যাবে। এতে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়বে বাংলাদেশী পাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিদেশে সস্তা দরে পণ্য রফতানি করছে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আশায়। এতে রফতানি কতটা বাড়ছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসার মধ্যদিয়ে। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী কম দরে কিনে ষোলোআনা লাভ নিশ্চিত করেই রফতানির পথে হাঁটছে। এরপরও যদি ওই রফতানি মূল্য সেই দেশের বাজার অপেক্ষা কম হয়ে থাকে বুঝতে হবে কৃষককে তারা কতটা ঠকিয়েছে। আর সস্তা দরের তেলেসমাতির স্লোগান তুলে দেশের ভাবমূর্তি কতটা বিনষ্ট করছে। সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, এর আগে ব্র্যান্ডিংয়ের পরিবর্তে তৈরি পোশাক খাতে সস্তা শ্রমের তেলেসমাতির ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এরই ফলশ্রুতিতে রানা প্লাজা, তাজরীন ও স্প্রেকট্রামের মতো অঘটন ডেকে আনা হয়েছে। অথচ এদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় মানসম্মত হওয়ার পরও এর ব্র্যান্ডিং হচ্ছে না। এখানে ব্র্যান্ডিং হয়েছে সস্তা শ্রমের।
এতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ সুযোগ কম দামের পণ্য আরও কম দামে কেনার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে ক্রেতারা। ওদিকে অ্যান্টি ডাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়ে ইতিমধ্যে ব্রাজিলের মতো বড় চাহিদাকারী রফতানি বাজার হারিয়েছে বাংলাদেশ। এ ক্রেতা দেশটির সরকার ১৯৯১ সালে ‘অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি’ আরোপ করে বাংলাদেশী পাটের ওপর। এরপর থেকেই সেখানে রফতানি কমতে শুরু করেছে। থাইল্যান্ড মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ভারত থেকে পাটের বস্তা শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করলেও স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া ৬৯৯৮ পণ্যের তালিকায় রাখা হয়নি পাটের বস্তাকে। ফলে ভারতীয় বস্তার কাছে দামে মার খাচ্ছে বাংলাদেশের পাটের বস্তা। এ দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার চীনে বাংলাদেশের পাট, পাটপণ্য শুল্ক ও কোটামুক্ত রফতানি সুবিধা ভোগ করলেও রফতানি কমছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে চীনে এ পণ্যের রফতানির ছিল ১২ কোটি ৫ লাখ ডলার। তারপর থেকে প্রতিবছর কমতে কমতে গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ২১ লাখ ডলারে। গত ৫ বছরে পাকিস্তানেও বাংলাদেশের পাট ও পাট পণ্য রফতানি অর্ধেকে নেমেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে পাকিস্তানে পাট ও পাটপণ্য রফতানির পরিমাণ ছিল সাত কোটি ১৯ লাখ ডলার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ১৫ লাখ ডলারে।

No comments

Powered by Blogger.