অস্থির শিক্ষাঙ্গন : রাজপথে শিক্ষক-শিক্ষার্থী by আমানুর রহমান ও এম তৌহিদ

প্রাইমারি স্কুল, কলেজ, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরেই বিরাজ করছে অস্থিরতা। নানা ইস্যুতে আন্দোলনে উত্তাল দেশের সব ক’টি শিক্ষাঙ্গন। কি পাবলিক কি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজ ও বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমন কি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সর্বত্র শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখন আন্দোলনে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল সম্পূর্ণ শান্ত ও নিরিবিলি, সেখানেই এখন তীব্র আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনের মুখে রাজধানী ঢাকা কয়েক দিন থেকে বলতে গেলে অচল ও স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রতিবাদের অগ্র সেনানি হিসেবে খ্যাত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন অনেকটাই নিশ্চুপ। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই এখন আন্দোলনে। বেতন ও মর্যাদার দাবিতে সরকার বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীর মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন তারা।
দেশের শিক্ষাঙ্গনে চলমান এই অস্থিরতা আকস্মিক নয়। এ আন্দোলনকে দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ ও বঞ্চনা এবং ধ্বংসের আগ মুহূর্তে জেগে উঠে প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষাঙ্গনের সর্বত্র অস্থিরতা নিয়ে শঙ্কায় অভিভাবক, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেশন জটের। দ্রুত এ অচলাবস্থার অবসান চাচ্ছেন সবাই। তবে সরকারের অনড় অবস্থান এবং আন্দোলনকারীদের পিছু না হটার অঙ্গীকার পরিস্থিতি দিন দিন নাজুক করে তুলছে। দুইপক্ষেরই ছাড় না দেয়ার প্রতিজ্ঞা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : অষ্টম জাতীয় পে-স্কেলে সন্মানহানি ও যোগ্য মর্যাদা না দেয়া এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে কর্মবিরতি, সমাবেশ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ প্রভৃতি কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। আগামী বৃহস্পতিবারও পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করবেন তারা। গত আগস্টে তিন ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করেন দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। দাবি আদায়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন শিক্ষকেরা।
এ দিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ আন্দোলন আরো উসকে দিয়েছে অর্থমন্ত্রীর একটি বক্তব্যে। তিনি মন্তব্য করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন জ্ঞানের অভাব’। তার এ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আরো বেশি ুব্ধ হয়ে ওঠেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং বিভিন্ন মহলের সমালোচনায় অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হন। তবে শিক্ষকদের দাবি দাওয়া আদায় না হওয়ায় তারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সাথেও সভা করেছেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ব্যানারে চলছে এ আন্দোলন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিকদের পূর্বঘোষিত চার দফা দাবি হলোÑ অবিলম্বে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন এবং এ জন্য বেতন কমিশন গঠন, সব বৈষম্য দূরীকরণপূর্বক সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের বেতনভাতা সিনিয়র সচিবের সমতুল্য করা এবং অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের বেতনকাঠামো ক্রমানুসারে নির্ধারণ করা, রাষ্ট্রীয় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে পদমর্যাদাগত অবস্থান নিশ্চিত করা এবং প্রযোজ্য েেত্র সরকারি কর্মকর্তাদের অনুরূপ গাড়ি ও অন্যান্য সুবিধা শিকদের েেত্রও নিশ্চিত করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাব ভবনে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সাথে কোনো আলোচনা করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা। তারা বলেছেন, বেতন বৈষম্য বিষয়ক যে কমিটি হয়েছে তার প্রধান হিসেবে অর্থমন্ত্রী রয়েছেন। ইতোমধ্যেই যিনি শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন এবং শিক্ষকদের ব্যাপারে প্রতিহিংসাপরায়ণ বক্তব্য রেখে নিজেকে বিতর্কিত করেছেন, সেই ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন কোনো কমিটি শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অন্যথায় ঈদের পরে কঠোর আন্দোলনে যাবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ দিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গতকাল কর্মবিরতি পালন করেছেন। তারা কোনো ধরনের রুটিন কাসে অংশ নেননি। তবে বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষায় তারা অংশ নেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন ও কর্মবিরতির কারণে শঙ্কায় দিন পার করছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা। তাদের আশঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ আন্দোলনের ফলে স্বল্প থেকে দীর্ঘমেয়াদি সেশন জটে পড়তে পারে। এ জন্য তারা এ অচলাবস্থার দ্রুত সমাধানে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় : দেশের শিক্ষাঙ্গনের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা ইস্যুতে প্রায় সব সময়ই উত্তপ্ত থাকলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা কখনো আঁচড় ফেলেনি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তে ফুঁসে উঠেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অব্যাহত আন্দোলনে একাধিক দিন প্রায় অচল ও স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। গত দুই দিনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন দেশের বড় শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম সিলেট, রাজশাহী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছেন। রাজধানীর মতো ওই সব শহরও অচল করে দেন শিক্ষার্থীরা।
সারা দেশে ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর এবং গতকাল ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ ছিল এক কথায় অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয়। কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে রাজধানী অচল হয়ে পড়ে। এ দুই দিন রাজধানীর কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি আন্দোলনকারীদের দ্বারা। শান্তিপূর্ণ এ প্রতিবাদ ও দাবি প্রকাশের ঘটনাটি ছিল নজিরবিহীন। একটি সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়িতে ফুলের টোকাও পড়েনি। কিন্তু তারা দাবি প্রকাশে ছিলেন সরব ও সক্রিয়।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন অনেকাংশে উসকে দিয়েছে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিবৃতি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভ্যাট শিক্ষার্থীদের নয় মালিকদের দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একই ধরনের কথা বললেও তিনিই আবার উল্টো কথাও বলেছেন। তিনি বলেছেন, এ ভ্যাট আল্টিমেটলি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপরই বর্তাবে। আরো বলেছেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এক হাজার টাকা খরচ করতে পারলে ৭৫ টাকা ভ্যাট দিতে সমস্যা কোথায়? গত শনিবার আরো বলেছেন, চলতি বছর শিক্ষার্থীদের ভ্যাট দিতে হবে না। কিন্তু পরবর্তী বছর অর্থাৎ আগামী অর্থবছর থেকে তাদের ভ্যাট দিতে হবে।
সরকারের এ সিদ্ধান্ত ও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে ুব্ধ করে তুলেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ দিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর বৃহস্পতিবার রাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ২০-২৫ জন যুবক হামলা করে। যারা ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজধানীর ধানমন্ডির ২৭ নম্বর এলাকায় হামলার ওই ঘটনা ঘটে।
গত তিন-চার দিনের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়মিত কাস ও সেমিস্টার পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ ভ্যাট তারাই পরিশোধ করার এবং ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় আগামী তিন বছর টিউশন ফি না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) ভিসি অধ্যাপক ড. আমিনুল হক ভূঁইয়ার অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ। আন্দোলন চলাকালে ৩০ আগস্ট ছাত্রলীগ ওই সব শিক্ষকের ওপর হামলা করে। পরদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই হামলার ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন ফলাও করে ছাপা হয়। তবে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে হামলার কথা অস্বীকার করা হয়। ওই দিন আন্দোলনরত শিকেরাও ভিসি আমিনুল হককে লাঞ্ছিত করেছেন বলে পাল্টা অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনায় সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল, ‘আমার গলায় দড়ি দেয়া উচিত’ বলে মন্তব্য করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। যদিও পরের দিন তিনি ছাত্রলীগের ‘বাচ্চা’ ছেলেরা শিক্ষকদের ওপর হামলা করতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন।
সরকারি কলেজ শিক্ষকেরাও আন্দোলনে : অষ্টম জাতীয় পে-স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেয়া এবং অধ্যাপকদের বিদ্যমান বৈষম্যমূলক বেতন স্কেল আপগ্রেডেশনের পরিবর্তে অবনমনের প্রতিবাদে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ১০ সেপ্টেম্বর সারা দেশে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেন সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা। কর্মবিরতি চলাকালে কলেজ শিক্ষকেরা সব ধরনের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মাস্টার্স পরীক্ষা বর্জন করেছেন। এক দিনের কর্মবিরতি শেষে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তারা আগামী ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দুই দিনের কর্মবিরতি পালন করবেন। সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহাসচিব আই কে সেলিম উল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতিভুক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষক ও বিভিন্ন শিক্ষা অধিদফতর ও পরিদফতরে কর্মরত ১৫ হাজার ক্যাডার কর্মকর্তা এ কর্মসূচিতে অংশ নেন।
জানা গেছে, সরকারি কলেজ ছাড়াও আলিয়া মাদরাসা, টিটি কলেজ, গভ: কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট, আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড এবং দু’টি বিশেষায়িত শিক্ষা (মাদরাসা ও কারিগরি) বোর্ড, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অফিস ও প্রকল্পে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন কর্মকর্তারা।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক সমিতি : সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিকেরা আজ সোমবার সারা দেশে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে পূর্ণদিবস কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক সমিতির সভাপতি মো: ইনছান আলী ও সাধারণ সম্পাদক জালালউদ্দিন সরকার জানান, কলেজ শিকদের দাবির পরিপ্রেেিত তারাও এ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সরকারি মাধ্যমিক সহকারী শিক সমিতি : পদোন্নতির সুযোগ খুবই কম থাকায় স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো ও টাইম স্কেল এবং সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালের দাবিতে গত শনিবার দেশের সব সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা কালোব্যাজ ধারণ করেন। গতকাল প্রতিটি বিদ্যালয়ে দাবি সংবলিত ব্যানার টাঙানো কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক সহকারী শিক সমিতি।
সংগঠনটির সদস্যসচিব মোখলেছুর রহমান চৌধুরী সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে সহকারী শিক্ষকদের জন্য একাধিক পদোন্নতি পদ সৃষ্টি, স্বতন্ত্র শিক্ষা অধিদফতর স্থাপন, সিনিয়র শিকদের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদায়নের ব্যবস্থার দাবি করেন।
প্রাইমারি শিক্ষা : প্রাইমারি শিক্ষা প্রায় সরকারীকরণ করা হলেও এখানে কর্মরত প্রধান শিক্ষক ও সরকারি শিক্ষকদের মধ্যে চলছে পদমর্যাদা ও বেতনকাঠামো নিয়ে তীব্র অসন্তোষ। গত এক বছর এ নিয়ে প্রাইমারি শিক্ষকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ ছাড়া ৯ জানুয়ারি ’১৩ তারিখে জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে সারা দেশের রেজিস্টার্র্ড ও রেজিস্টার্ডবিহীন এবং এনজিও পরিচালিত স্কুলের শিক্ষকদের মহাসমাবেশে তিন ধাপে তাদের চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। আজ ২০১৫ সালের শেষে এসেও জাতীয়করণ সম্পন্ন হয়নি।
প্রধান শিক্ষক ও সরকারি শিক্ষকদের পদ মর্যাদা ও বেতনকাঠামো নিয়ে টানাপড়েন : আলোচিত ৫ জানুয়ারি ’১৪ নির্বাচনের আগে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকেরা ২য় শ্রেণীর মর্যাদা এবং জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড-১১ এবং প্রশিক্ষণবিহীন প্রধান শিক্ষকেরা একই মর্যাদা ও বেতন স্কেলের গ্রেড-১২’র সুবিধা পাবেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকেরা ৩য় শ্রেণীর মর্যাদা এবং জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড-১৫ এবং প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষকেরা একই মর্যাদা ও বেতন স্কেলের গ্রেড-১৫’র সুবিধা পাবেন। নির্বাচনের দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর নতুন বেতন স্কেলেও কোনো সমাধান (পদ-মর্যাদা বৃদ্ধি এবং গ্রেড উন্নীত) না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে স্বনামে কোনো শিক্ষক নেতা এ নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিবর্তনের আশঙ্কাও তাদের মধ্যে রয়েছে। একাধিক শিক্ষক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সারা দেশে যেভাবে গুম-খুন-অপহরণ চলছে তাতে কেউই নিরাপদ নন। এ ছাড়া আমরা সরকারি চাকরি করি। সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা বা এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা চাকরিবিধি লঙ্ঘনের শামিল।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে নির্বাচনকালীন ঘোষণার ব্যাপারে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে কোনো সমাধান না থাকায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন শিক্ষকেরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষক নেতারা বলেন, প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য কোনো ঘোষণা বা নির্দেশনা নেই। সহকারী শিক্ষকরা আবার বৈষম্যের শিকার হলেন।
২০১৩ সালজুড়ে প্রাথমিক শিক্ষক আন্দোলনে সব প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের মূল দাবি ছিল প্রধান শিক্ষকের একধাপ নিচে সহকারী শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ। কিন্তু সম্প্রতি অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষকদের সুবিধা সম্পর্কে যে সম্মতি পাওয়া গেছে; তাতে প্রধান শিক্ষকের এক ধাপ নিচে বেতন নির্ধারণের পরিবর্তে সহকারী শিক্ষকদের তিন ধাপ নিচে বেতন নির্ধারণের সিদ্ধন্তে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে আরো বেশি বেতন বৈষ্যমের সৃষ্টি হবে।
অনেক সহকারী শিক্ষক নয়া দিগন্তকে বলেছেন, সহকারী শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকদের হাতে সব সময় নিগৃহীত হয়ে আসছেন। আন্দোলনের ঘোষণা মতো বেতন স্কেল বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রধান শিক্ষকেরা সহকারী শিক্ষকদের পাত্তাই দিচ্ছেন না। অনেক সহকারী শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রধান শিক্ষকদের চেয়ে বেশি হলেও প্রাপ্য সন্মানটুকুও দেয়া হয় না। এ নিয়ে সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। দাবি বাস্তবায়ন হলে হতাশা কিছুটা হলেও লাঘব হতো।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সভাপতি ও প্রবীণ শিক্ষক নেতা মুহা: আ: আউয়াল তালুকদার সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য সম্পর্কে নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বাধীনতার আগে থেকেই শিক্ষকেরা বেতন বৈষম্যের শিকার। ৭৩ সালে প্রথম জাতীয়করণের আগে প্রধান শিক্ষকদের বেতন ছিল ১৩৫ টাকা। সহকারী শিক্ষকদের ছিল ১২০ টাকা। জাতীয়করণের পর হয়েছে ২২০ টাকা ও ১৪৫ টাকা। তখন সরকারি কর্মচারীদের (৩য় শ্রেণীর) বেতন ছিল ২২০ টাকা। তখন থেকেই শিক্ষকেরা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার শিক্ষকদের দাবি মেনে নিলেও ঘোষণা বাস্তবায়নের আগেই নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
সহকারী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি মো: ওহিদুর রহমান নয়া দিগন্তকে জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭৩ সালে সর্বপ্রথম জাতীয়করণের সময় সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের বেতনের পার্থক্য ছিল মাত্র ১০ টাকা। ’৭৭ সালে ঘোষিত স্কেলে প্রধান শিক্ষকদের বেতন সহকারী শিক্ষকদের চেয়ে এক ধাপ ওপরে ছিল। এরপর ২০০৬ সালে বেতন বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলনে প্রধান শিক্ষকদের দুই ধাপ নিচে সহকারী শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করায় প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্যের সূত্রপাত ঘটে আবারো। এবার প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচে সহকারী শিক্ষকেরা বৈষম্যের শিকার হলেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক সমিতি : সহকারী প্রাথমিক শিকদের বেতন ১১তম গ্রেডে পুনর্নির্ধারণ, সরাসরি প্রধান শিক পদে নিয়োগ বন্ধ করে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করাসহ ১১ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক সমিতি। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার সব দায়িত্ব বর্জন ও কর্মবিরতির কর্মসূচি পালনে বাধ্য হবেন বলে জানিয়েছেন তারা। সমিতির সভাপতি নাসরিন সুলতানা বলেন, সহকারী শিকেরা ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। স্বাধীনতার পর ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক ও সহকারী শিকদের মধ্যে বেতনের পার্থক্য ছিল এক ধাপ। ২০০৬ সালের বেতন স্কেলে সেটি দুই ধাপ হয়। গত বছরের ৯ মার্চ প্রধান শিক ও সহকারী শিকদের বেতন ব্যবধান তিন ধাপ বাড়িয়ে এক হাজার ২০০ টাকা করা হয়। সর্বশেষ অষ্টম বেতন স্কেলেও তিন ধাপ ব্যবধান রাখা হয়েছে। এটি শিকদের জন্য অবমাননাকর।
জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্কট : বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘ ২২ বছরের দাবি আর আন্দোলনে ৯ জানুয়ারি ’১৩ জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে সারা দেশের রেজিস্টার্র্ড ও রেজিস্টার্ডবিহীন এবং এনজিও পরিচালিত স্কুলের শিক্ষকদের মহাসমাবেশে তিন ধাপে তাদের চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সারা দেশের রেজিস্টার্র্ড ও রেজিস্টার্ডবিহীন এবং এনজিও পরিচালিত প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের কাজ থেমে আছে। তিন ধাপে এ কাজ সম্পন্নের কথা। কিন্তু প্রথম ধাপের শিক্ষকেরা সরকারি বেতন পেলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের শিক্ষকরা এখনো গেজেট পাননি। দ্বিতীয় ধাপের শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের গেজেট হলেও শিক্ষকদের গেজেট প্রকাশ করা হচ্ছে না। বিদ্যালয়ের গেজেট হয়েছে ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর। ঘোষণা অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপের ১৭৭০টি বিদ্যালয়ের প্রায় ৮ হাজার শিক্ষকদের বেতন পাওয়ার কথা ১ জুলাই ২০১৩ থেকে। তৃতীয় ধাপের ৯৬০টি বিদ্যালয়ের প্রায় ৩৮৪০ শিক্ষকের সরকারি বেতন পাওয়ার কথা ১ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে। দ্বিতীয় ধাপের শিক্ষক গেজেট এবং তৃতীয় ধাপের বিদ্যালয় ও শিক্ষক গেজেট না হওয়ায় শিক্ষকেরা হতাশ। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে পদ সৃষ্টির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো হলেও গত দুই বছর অতিবাহিত হচ্ছে আমলাতন্ত্রিক জটিলতায় আজো গেজেট হয়নি। সে কারণে তৃতীয় ধাপের কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের শিক্ষকেরা বেতন না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ নিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করে আসছেন। আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ বিক্ষোভের কথা ভাবছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নেতারা।

No comments

Powered by Blogger.