মক্কা ট্র্যাজেডিতে বাংলাদেশী নিহত: আল-আরাবিয়ার রিপোর্টের সত্যতা পায়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

মক্কার মসজিদ আল হারামে ক্রেন দুর্ঘটনায় আবুল কাশেম (সুফি) নামের এক বাংলাদেশী হজযাত্রী নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তিনি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাঞ্চনগঞ্জ গ্রামের আনু মিয়ার ছেলে । ওই ঘটনায় আবদুর রব নামের এক বাংলাদেশী হজযাত্রী এখনও নিখোঁজ রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আহত ৪০ বাংলাদেশী বাংলাদেশী হজযাত্রীদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি ৩৯ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার নিজাম উদ্দীন মক্কার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এদিকে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক দৈনিক আল-আরাবিয়ার এক রিপোটে ওই ক্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ১০৭ জনের মধ্যে ২৫ জন বাংলাদেশী রয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। হতাহতের ব্যাপারে প্রাথমিক রিপোর্ট যাচাইয়ের পর আল-আরাবিয়া বলছে, নিহতদের মধ্যে ২৫ বাংলাদেশী ছাড়া ১৫ পাকিস্তানি, ২৩ মিশরীয়, ১০ ভারতীয়, ২৫ ইরানি, ৬ মালয়েশীয়, এক আলজেরীয় ও এক আফগান নাগরিক রয়েছেন। গতকাল বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে আল আরাবিয়ার বরাতে খবরটি প্রকাশের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিক সৌদি আরবস্থ দূতাবাস ও হজ অফিসে এর সত্যতা জানতে চায়। মানবজমিনের তরফেও খবরের সত্যতা জানার চেষ্টা করা হয়। তবে কোন সূত্রই এর সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ সত্যতা পায়নি বলে মন্ত্রণালয়ের ডিজি (কনসুলার) লুৎফুর রহমান জানান। সৌদি হজ অফিস পররাষ্ট্র দপ্তরে গতকাল সন্ধ্যায় সর্বশেষ যে রিপোর্ট পাঠিয়েছে এক বাংলাদেশীসহ ওই ঘটনায় বিভিন্ন দেশের ১০৮ জন নাগরিক নিহত এবং ৪০ বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের দুই শতাধিক হজ যাত্রী আহত হওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
এদিকে বিবিসি জানিয়েছে, ঘটনার পরপর আতঙ্কিত মানুষের ছোটাছুটির কারণে পদপিষ্ট হয়ে এবং মসজিদের ভেতরে ছাদের ভগ্নাংশের নিচে চাপা পড়ে ঠিক কত মানুষ আহত হয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যা এখনও নির্ণয় করা যায়নি। দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশী হজ পালনেচ্ছু ও প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য ইতিমধ্যে হটলাইন চালু করেছে দেশটিতে বাংলাদেশের হজ অফিস ও বাংলাদেশ মিশন। জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল ও মক্কার হজ মিশন দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের ও সংশ্লিষ্ট হজ এজেন্সিগুলো এবং সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। যে কোন সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্টদের মক্কায় বাংলাদেশ হজ অফিস কনসাল মো. জহিরুল ইসলামের সঙ্গে +৯৬৬(০)৫০৪৩২১৫২৭ এবং জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের ফার্স্ট সেক্রেটারি (লেবার) আলতাফ হোসাইনের সঙ্গে +৯৬৬(০) ৫৩৪৪৫৫৭১৬ নম্বরে যোগাযোগের জন্য বলা হয়েছে। এদিকে, শনিবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান সৌদি বাদশাহ সালমান। হাসপাতালে আহতদেরও দেখতে যান তিনি। এই দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। আর সৌদি আরবের বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সুলাইমান আল-আমর জানিয়েছেন, ক্ষতি নির্ধারণ ও মসজিদের নিরাপত্তা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। হজ পালনের জন্য চলতি মাসে সারা বিশ্ব থেকে ২০ লাখেরও বেশি মুসলমান মক্কায় সমবেত হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। হজ পালনে এই দুর্ঘটনার কোন প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা। প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ মুসলমান হজ পালন করতে মসজিদ আল-হারামে সমবেত হন। এবার প্রায় এক লাখ বাংলাদেশীর হজে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।
কাবা তাওয়াফের ব্রিজ সাময়িক বন্ধ থাকবে
নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এবার হজে পবিত্র কাবা তাওয়াফ করার জন্য ব্যবহৃত ব্রিজ সাময়িক বন্ধ রাখা হবে। সাধারণত এ ব্রিজের ওপর দিয়ে যারা হাঁটতে অক্ষম অথবা বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন তাদেরকে নিয়ে তাওয়াফ করানো হয়। গতকাল অনলাইন সৌদি গেজেট এ খবর দিয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, হজের ব্যস্ততার কারণে এ সপ্তাহ থেকেই হজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পবিত্র নগরী মক্কার সব স্কুল ও কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুক্রবার ক্রেন দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ আরও সতর্ক হয়েছে। বলা হয়েছে, কাবা শরিফ তাওয়াফ করার জন্য রয়েছে দ্বিতল ব্রিজ। এর প্রশস্ততা ১২ মিটার। মাটি থেকে এর উচ্চতা ৩৪ মিটার। পবিত্র দুই মসজিদবিষয়ক জেনারেল প্রেসিডেন্সির এক সূত্র বলেছেন, হজযাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবার ব্রিজের ওপর দিয়ে কাবা তাওয়াফ করার রীতি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ব্রিজ দুটি অস্থায়ী ভিত্তিতে নির্মাণ করা হয়েছিল। যতদিন মূল মাতাফ (ব্রিজের বিকল্প) তৈরি করা না হচ্ছে ততদিন এ ব্রিজ তাওয়াফে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। কিন্তু এবারের কথা ভিন্ন রকম। কারণ, এরই মধ্যে ক্রেন দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যুতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ওই ব্রিজ দুটি এবার বন্ধ থাকবে। ওদিকে মক্কা নগরীর শিক্ষাবিষয়ক পরিচালক মোহাম্মদ আল হারথি বলেন, মক্কার ২৫৩টি স্কুল ও কলেজের ক্লাস স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী আজম আল দাখিল। পবিত্র হজকে সামনে রেখে এরই মধ্যে মক্কায় সমবেত হয়েছেন কয়েক লাখ হজযাত্রী। তার সঙ্গে আছেন স্থানীয় বাসিন্দা। ফলে রাস্তায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এ জন্য অনেক অভিভাবকও ক্লাস বন্ধের জন্য অনুরোধ করেছেন।
ওদিকে আল এরাবিয়া নিউজ বলেছে, নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ২৫ বাংলাদেশী। তবে রিপোর্টে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয় নি। শুক্রবার মক্কায় ক্রেন ভেঙে আল হারাম শরিফের তৃতীয় তলায় পড়ে। এতে কমপক্ষে ১০৭ জন নিহত হন। ওই রিপোর্টে বলা হয়, তারা প্রাথমিক রিপোর্ট অনুসন্ধান করে দেখতে পেয়েছে যে, নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ১৫ পাকিস্তানি, ২৩ মিশরীয়, ১০ ভারতীয়, ২৫ ইরানি, ৬ মালয়েশিয়ান, ২৫ বাংলাদেশী, একজন আলজেরিয়ান ও একজন আফগান। সৌদি আরবের বাদশা সালমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি ক্রেন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি বলেছেন, তদন্ত চলছে। এর রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। সরকারি বার্তা সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সি বলেছে, বাদশা সালমান দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেন। এর কোন প্রভাব পবিত্র মসজিদে পড়বে কিনা তা নিয়েও আলোচনা করেন তিনি। ওদিকে সৌদি আরবের সুপরিচিত বিজ্ঞানী প্রফেসর মানসুর আলমাজরৌ বলেছেন, বাতাসের কারণেই ক্রেন ভেঙে পড়েছে। তিনি জেদ্দাভিত্তিক কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চ-এর পরিচালক। তিনি বলেন, ক্রেনটি ভেঙে পড়ার আগে একদিকে যেমন ছিল বাতাস, তার ওপর একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে ক্রেনটির ওপর বজ্রপাত হয়েছে।
মক্কায় নিহতদের মধ্যে একজন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা
কলকাতা প্রতিনিধি জানান, সৌদি আরবের মক্কায় মসজিদ আর-হারামে ক্রেন ভেঙে যে শতাধিক ব্যক্তি মারা গিয়েছেন তার মধ্যে দুজন ভারতীয়। নিহত দুই ভারতীয়র মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের বাসিন্দা একজন রয়েছেন। তার নাম মনিজা আহমদ (৫৯) । এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন আহতদের তালিকায় রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ রুপি এবং আহতদের জন্য ১ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেবার কথা ঘোষণা করেছেন।  ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ জানিয়েছেন, আল-হারাম মসজিদের দুর্ঘটনায় দুই ভারতীয়র মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৫ জন ভারতীয়। আহতদের মধ্যে ১১ জনই হজ কমিটির সদস্য। পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে জেদ্দায় ভারতীয় দূতাবাসকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। ঘটনায় শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

No comments

Powered by Blogger.