একটি মেহেদি গ্রামের কথা by মানসুরা হোসাইন

ব্যবসায়ী মোখলেছ কাজে ব্যস্ত। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
হলদি বাটো, মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ, বিয়ের সাজে সাজবে কন্যা...গানের কথাগুলোর সেই দিন আর নেই বললেই চলে। এখন আর বিয়েতে কষ্ট করে কেউ কন্যার দুহাত রাঙানোর জন্য মেহেদি বাটে না। হাতের কাছেই আছে বিভিন্ন কোম্পানির কৃত্রিম মেহেদির টিউব। কিন্তু তাই বলে কি বাটা মেহেদির কদর শেষ? না তা নয়। এখন বিভিন্ন বয়সী নারী এমনকি পুরুষের কাছেও বাটা মেহেদির কদর বেড়েছে। হাত আর পা রাঙানোর পাশাপাশি মেহেদি এখন ব্যবহার হচ্ছে মাথায়, অনেকটা ওষুধের মতো। কারও চুলে পাক ধরেছে তাই একটু কায়দা করে মেহেদি লাগিয়ে মাথার চুলটা রাঙিয়ে নেন। এ ছাড়া মাথার খুশকি দূর করতে, রাজ্যের চাপে মাথা গরম হয়ে গেলে মাথাটা একটু ঠান্ডা করতেও এটি ব্যবহার করছেন অনেকে।
শিশুরাও কাজে হাত লাগিয়েছে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
শহরে ভ্যানে ভ্যানে সবজি বিক্রেতাদের কাছে পাওয়া যায় মেহেদির আঁটি। সবজি কেনার ফাঁকে অনেকে কিনে নিচ্ছেন তা। কিন্তু তাজা মেহেদি পাতার এই আঁটি শহরে এল কোত্থেকে? এর উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে ঢাকার কেরানিগঞ্জ থানার পূর্ব আকছাইল, সলমাছি, কলাতিয়া ও মানিকনগরসহ কয়েকটি গ্রামে। এই গ্রামগুলোতে অন্যান্য শাকসবজি ও ফসলের মতোই সারা বছর বাড়ির আশপাশে অনেক এলাকা নিয়ে চাষ হচ্ছে মেহেদির। এর ব্যবসা চলছে বহু বছর ধরে। আর এ ব্যবসায় হাত লাগান পরিবারের নারী, পুরুষ এমনকি স্কুল পড়ুয়া শিশুও। জমির মালিকরা বিভিন্ন চুক্তিতে ভাড়া দিচ্ছেন অন্যদের কাছে। মেয়াদ শেষ হলে তিনি আবার অন্য জনের কাছে ভাড়া দেন সে জমি।
সালমা বেগম সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি মেহেদির আঁটি বাঁধছেন। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
শনিবার দুপুরের দিকে কেরানিগঞ্জের পূর্ব আকছাইল গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল, প্রস্তুতি চলছে মেহেদির ডাল শহরে পাঠানোর। বাড়ির ভেতর উঠান আর রান্না ঘরের পাশে বসে নারীরা মেহেদি পাতা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ঘরের বাইরে পুরুষরা ব্যস্ত। গ্রামের হিন্দু পরিবারের সদস্যরা মেহেদির চাষ করেন না। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি অনেক নারী ও শিশু মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছেন। এরা সবাই অভাবী তা বলা যাবে না।
তিন ছেলে ও এক মেয়ের মা রাশিদা জানালেন, মেহেদির দুই তিনটি ডাল দিয়ে ছোট ছোট আঁটি ১০০টি বাঁধলে পান ছয় টাকা। কোনো কোনো দিন দিনে ২০০ টাকাও পান এ কাজ করে। রাশিদা বলেন,‘ সংসারে যে খুব অভাব তা না। খালি খালি বইস্যা না থাইক্যা এই কাজ করি। যে টাকা পাই তা দিয়া সংসারের কাজে লাগাই। এ কাজ না করলে তো বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম, এর কথা ওর কথা নিয়া লাগালাগি করতাম। এখন আর তা হয় না।’ গ্রামটিতে বয়স্ক ব্যক্তিদের কারও কারও সাদা চুল এবং দাড়িতে মেহেদির কমলা রং।
নিজের মোদির দোকানের সামনে বসে মেহেদির আঁটি বাঁধার কাজ করছিলেন মহিউদ্দিন ও তাঁর বাবা। মহিউদ্দিন এবার দ্বিতীয় রোজায় মেহেদি বনের মালিকের কাছ থেকে ৫ পাখি জমি ৫০ হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছেন। এক বছরের জন্য তিনি জমিটি নিয়েছেন। বছরে পাঁচবার মেহেদি কাটা হবে। তিনি একবার কেটেছেন। এ ছাড়া তাঁর নিজস্ব ২ পাখি জমিতেও মেহেদি চাষ করেছেন। রাজধানীতে রায়েরবাজার আড়তদারের কাছে দিন শেষে মেহেদি বিক্রি করবেন। ২০ মুঠা বা আঁটি বিক্রি করবেন ১০০ টাকায়। শহরের বিক্রেতারা পরে তা যখন যা পাবেন সেই দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করবেন। শীতে মেহেদির চাহিদা কম থাকে। চাহিদা বাড়ে বছরের এ সময়টাতেই। বাজারে যখন মেহেদির চাহিদা খুব বেশি থাকে না তখন মহিউদ্দিনসহ গ্রামের অন্যরা মোদি দোকান, গৃহস্থ বা অন্যান্য কাজ করেন। তবে মেহেদির ব্যবসা বলতে গেলে ১২ মাসের ব্যবসা।|
মেহেদি বন। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
বেশিদূর পড়াশোনা করেননি মহিউদ্দিন। তিনি জানালেন, বাজারের টিউব মেহেদির কারণে তাঁদের ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। আগে নারীরা বাটা মেহেদিতে হাত রাঙানোর জন্য নিতেন। এখন আর নিচ্ছেন না। টিউবে আসলে মেহেদির পাতার ব্যবহার থাকে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন তিনি। তবে যাঁরা মাথায় মেহেদি দেন তাঁরা নিয়মিতই কেনেন মেহেদির তাজা পাতা।
মহিউদ্দিন মেহেদি এবার খেত ভাড়া নিয়েছেন আফাজউদ্দিনের কাছ থেকে। আফাজউদ্দিন গত দুই থেকে তিন বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তিনি জানালেন, তিনি প্রায় ১৩ পাখি জমিতে মেহেদি চাষ করেছেন। তাঁর সব জমি ভাড়া দেওয়া। কৃত্রিম মেহেদি টিউবের ওপর আফাজউদ্দিনের ক্ষোভ। এতে মেহেদি পাতার দাম কমে গেছে বলে জানালেন।
আইয়ুব আলীর বয়স ৬০ বা ৬৫ বছর। তাঁর ভাষায়-‘বুদ্ধি হইছে তখন থেইক্যাই মেহেদির কাজ করি। এখন নাতি ইস্কুলে যায়, ও ইস্কুলের পাশাপাশি কাজে হাত লাগায়।’
আইয়ুব আলী মেহেদির ব্যবসা করে ইট সিমেন্টের মেঝে এবং টিন দিয়ে বড় ঘর তুলেছেন। দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলেকে চার লাখ টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছিলেন। ছেলে সেখানে ১৮ মাস থেকে চলে এসেছে। কোরবানি ঈদের পর ওই ছেলেকেই আবার সাত থেকে আট লাখ টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুর পাঠানোর চেষ্টা করবেন। আরেক ছেলে কাঁচামাল বিক্রির ব্যবসা করছে।
মোখলেছ নামে আরেকজন এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্যের জমি বন্ধক নিয়ে মেহেদির ব্যবসা করছেন। সকালে মেহেদির ডাল কাটা, আঁটি বাঁধা, শহরে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে তাঁর স্ত্রী তাঁকে সাহায্য করেন। জমি থেকে মেহেদির ডাল কেটে তিনি আবার তাঁর নিজস্ব জমিতে লাগিয়েছেন। সেখান থেকে নতুন খেত হচ্ছে। এ ব্যবসায় লাভ হয় প্রশ্ন করতেই এক গাল হেসে মোখলেছ বলেন, ‘লাভ না হইলে কি আর ব্যবসা করি?’

No comments

Powered by Blogger.