শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও উপাচার্য বহাল by শরিফুল হাসান

নিয়োগ-বাণিজ্য, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ মিললেও বহাল তবিয়তে আছেন রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শাদাত উল্লা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর তদন্ত করে চার মাস আগেই ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল।
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বিঘ্নিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত সেই ব্যবস্থা নেয়নি।
অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার হস্তক্ষেপের কারণে উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন পেয়েছে। এটি মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কাছে দেওয়া হয়েছে। তারা পর্যালোচনা করছে। এরপর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
গত বছরের শেষে উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও ইউজিসিতে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২ ডিসেম্বর ইউজিসির সদস্য মোহাম্মদ মোহাব্বত খানকে আহ্বায়ক এবং অতিরিক্ত পরিচালক ফেরদৌস জামানকে সদস্যসচিব করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট ৪৬ জনের সঙ্গে কথা বলেন। সাতজন শিক্ষক প্রতিনিধিদলও কমিশনে গিয়ে বক্তব্য দেন। কমিটি ১২ এপ্রিল শিক্ষা সচিবের কাছে তাদের প্রতিবেদন দেয়।
কমিটির দুজন সদস্য প্রথম আলোকে জানান, প্রতিবেদন দেওয়ার পর যা করার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই করবে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল অতিরিক্ত নিয়োগ। গত বছর প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর ৩০টি পদের অনুমোদন নিয়ে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ৭৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইউজিসির প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, ইউজিসি ১০ জন শিক্ষক, চারজন কর্মকর্তা ও ১৬ জন কর্মচারীসহ মোট ৩০টি পদে নিয়োগের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়। কিন্তু উপাচার্য ১০ জন শিক্ষকের জায়গায় ২৯ জন শিক্ষক, চারজন কর্মকর্তার জায়গায় ২৪ জন এবং ১৬ জন কর্মচারীর স্থলে ২২ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ পাওয়া শাখা কর্মকর্তাদের মধ্যে ১১ জনই ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা। এ ছাড়া ছাত্রলীগের দুজন নেতার স্ত্রীও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগেরও তদন্ত করেছে ইউজিসি। এতে বলা হয়, বিভিন্ন সময় পয়লা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহাসহ বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি অতিরিক্ত হিসেবে ১৭ লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্যায়ভাবে তুলে খরচ করেছেন।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে আত্মীয়স্বজনকে অবৈধভাবে নিয়োগেরও প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে উপাচার্য তাঁর শ্যালক চৌধুরী এম সাইফুলকে নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁর ছিল না। এ ছাড়া বেআইনিভাবে সাইফুল ইসলামের স্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য, যাঁর বয়স চল্লিশের ওপরে। ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও উপাচার্য তাঁর এক ভাতিজিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন নীতিমালা অনুযায়ী উপাচার্য সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু তিনি নিয়মের তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত দুটো গাড়ি ব্যবহার করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরে প্রথম হওয়া প্রার্থী থাকলেও ফজলুল হককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি মাত্র স্নাতক শেষ করলেও পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়নি। কেবল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সনদ দেখিয়ে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, উপাচার্যের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ, আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দেওয়াসহ সুনির্দিষ্ট ছয়টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আর ৬৫ বছর বয়স অতিক্রম করায় তিনি স্বাভাবিকভাবেই অবসরে গেছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাবতীয় পাওনা তুলে নিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ইউজিসির সুপারিশে বলা হয়, অভিযোগগুলো প্রমাণিত হওয়ায় সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ছাড়া উপাচার্যের বিভিন্ন খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দুই ভাগে বিভক্ত। ফলে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত শিক্ষক-কর্মচারী থাকায় অতিরিক্ত নিয়োগ স্থগিত রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে বিভিন্ন দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে যে অর্থ নিয়েছেন, সেই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে ফিরিয়ে দিতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.