গন্তব্যহীন অবরোধ কর্মসূচি এবং... by কাফি কামাল

কেন হঠাৎ করে খালেদা জিয়া অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিলেন তা আজও এক রহস্য। সহিংস এ আন্দোলন থেকে কি পেলো বিএনপি। কেনইবা দলটি পাল্টা চাল দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। একই দলের রাজনীতি করেও বিএনপি নেতাদের ভাগ্য কেন আলাদা। এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে বিএনপির ময়নাতদন্তের এবারের পর্বে। লিখেছেন আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা কাফি কামাল-
২০১৪ সালে একাধিক অনুষ্ঠানে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলেছিলেন, ভুল সংশোধন করে ফের আন্দোলনে যাবে বিএনপি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল উল্টো। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের এক বছর পূর্তির দিনে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দলের পরস্পরবিরোধী কঠোর অবস্থানের মুখে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে মারমুখো।
বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচিস্থলে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে প্রশাসনকে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ-সংগঠনগুলো। মূলত গাজীপুর থেকেই শুরু হয় এ প্রতিবন্ধকতা। ৫ই জানুয়ারি ঘোষিত প্রতিবাদ সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৩রা জানুয়ারি রাতেই বিএনপির দপ্তর সম্পাদককে কার্যালয় থেকে উঠিয়ে পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি এবং খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে। তখন দেখা গেছে বিএনপি উপযুক্ত বিকল্প কৌশল দিতে পারেনি। সরকারের তরফে এরকম অন্যায্য বাধা যে আসতেই পারে, তা কারও অনুমানের বাইরে থাকার কথা নয়। কিন্তু বিএনপিকে চৌকসভাবে পা ফেলতে দেখা যায়নি। বরং পদে পদে তাদের ভীরুতা ফুটে উঠেছে। ৫ই জানুয়ারিতে নির্দিষ্টভাবে সমাবেশ করতে না চেয়ে ওই একই আবেদনে কয়েকটি তারিখ তারা দিতে পারত। এর ফলে প্রশাসন বিপাকে পড়ত। কিন্তু কেবল ৫ই জানুয়ারিতেই সভা করতে চেয়ে ‘পাল্টাপাল্টি’ অবস্থা সৃষ্টিতে সহযোগিতা দিয়েছে বিএনপি। প্রশাসন এর সুযোগ নিয়েছে। মানুষ দেখেছে একদিনে দুই কর্মসূচি হলে সহিংসতা বাড়ত। 
৫ই জানুয়ারি অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে মূল কর্মসূচিতে যেতে চাইলে পুলিশের বাধা বিস্ময়কর ছিল না। একপর্যায়ে পেপার স্প্রে ছোড়ার ঘটনা ঘটে। ওই সময় গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের মুখে পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে ‘অনির্দিষ্টকালের অবরোধ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া। যখন এটা ঘোষণা করা হয়, তখনও বিএনপির অনেক বড় নেতারই জানা ছিল না, কোথাকার পানি কোথায় গড়াতে পারে। পরিণাম কি হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো হোমওয়ার্ক ছাড়াই ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘতম অবরোধ ডাকা হয়।  
কিন্তু এবার বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে বিএনপির রাজনীতি। দিনের পর দিন কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয় খালেদা জিয়াকেই। গণগ্রেপ্তার শুরু হয় সারা দেশে। ঢাকায় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ডজন ডজন সিনিয়র নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আত্মগোপনে থেকে দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনকালে যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয় একটি দল। বিএনপির যে দু-একজন নেতা কোনভাবে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন, তাদের কাছে এ ঘটনা ছিল এক ভয়ঙ্কর সতর্কবার্তা।
অন্যদিকে অনির্দিষ্টকালের কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে সারা দেশে প্রতিদিনই একের পর এক নাশকতার ঘটনা ঘটতে থাকে। এসব ঘটনায় বিএনপির বিরুদ্ধে উগ্রবাদী প্রচারণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বিএনপির আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও আইনি জালে বিএনপি নেতৃত্বকে আটকে ফেলে সরকার।
কিন্তু দ্রুত ভুল না শুধরে অপরিণামদর্শী কর্মসূচিটি গন্তব্যহীনভাবে চালিয়ে নিতে থাকে বিএনপি। এ সময় বিশ্ব ইজতেমা ও পাবলিক পরীক্ষার মতো ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলন থেকে সরে আসা বা বিকল্প কর্মসূচির দিকে যেতে ব্যর্থ হয় তারা। হঠাৎ ঘোষিত অদূরদর্শী ও গন্তব্যহীন এ কর্মসূচিকে তিনমাস টেনে নেয়ার বিষয়টি বিএনপির ‘ঐতিহাসিক ভুল’ সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। টানা কর্মসূচি চলাকালে বিএনপি চেয়ারপারসন নিজেই বলেছেন, ‘যৌক্তিক পরিণতি’ না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। কিন্তু ভুল চালের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে টানা অবরোধ ও হরতালের কর্মসূচি কোন প্রাপ্তি দেয়নি বিএনপিকে। এরপর সিটি নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আন্দোলন থেকে সরে আসতে হয়েছে বিএনপিকে। শেষ পর্যন্ত গন্তব্যহীন এ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বিরোধী জোট কিন্তু তাতে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়েনি। বরং ‘জঙ্গি শক্তি’ এবং ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার আন্দোলন’ এর তকমা নুতন করে তারা ললাটে লিখেছে।
নাইন ইলেভেনের পরে বিএনপির জামায়াতকে নেয়া ‘অসময়ের’ বলে চিহ্নিত ছিল। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের রসায়ন বুঝতে তো পারেইনি, বরং চীনকে চটিয়েছে। এরপর বিএনপির ভুল সবই ভুল। ফারুকের ভায়রা ভাইকে প্রধান উপদেষ্টা পদে যোগ্য করেও তারা তাকে দায়িত্ব নেয়াতে পারেনি। তিনি দায়িত্ব নিয়ে ফেললে আরও ক্ষতিকর ইয়াজউদ্দিন উপাখ্যান হয়তো সৃষ্টি হতো না। কারণ একজন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে এদেশে যা করা যায়, তা একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে করা সম্ভব হয় না। বিএনপি এটা ঠেকাতে পারেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচন তারা বয়কটও করতে পারেনি। আবার ৫ বছর পরে ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবে তারা নির্বাচনে যেতে পারেনি। ততদিনে গোটা বিশ্ব বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ঠেকাতে একাট্টা হয়েছে। আর তখন বিএনপি আর জামায়াতে ইসলামী ছাড়তে পারছে না। বরং, তখন তারা পশ্চিমা বিশ্বের মিত্রদের স্তব্ধ করে দিয়ে হেফাজতে ইসলাম উদ্ধারে নেমেছে। অথচ তারা গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায় বিএনপি জামায়াতের বিরুদ্ধে বিএনপির ঐতিহাসিক আইনি লড়াইকে তারা পুঁজি করতে পারতো। জিয়া, খালেদা জিয়া কেউ গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেননি। যুদ্ধারাধের বিচার ইস্যুতে বিএনপির ক্ষতি সামান্য। কিন্তু জামায়াতের  কাছে প্রশ্ন তার অস্তিত্ব রক্ষার। জামায়াত রাজপথে অরাজনৈতিক পথে বিএনপিকে এড়িয়ে জয়ী হতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। ওই পর্বের পরে জামায়াতকে আর  ব্যাপকভিত্তিক প্রকাশ্য সহিংসতায় দেখা যায়নি। বিএনপির ডাকা কোনো আন্দোলনেই জামায়াত তার পেশি শক্তি ব্যবহার করেনি। এখন তার বড় ঢাল বিএনপির সঙ্গে লেপ্টে থাকা। জামায়াতের নতুন প্রজন্ম হয়তো একদিন দলের কলঙ্ক ঘোচাতে নাম পাল্টাবে, জাতির কাছে ক্ষমাও চাইবে, কিন্তু তখন তা আর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির কাজে লাগবে না।
বিএনপিকে অবরোধ চালিয়ে নিতে শরিকদের মধ্যে কারা মদত যুগিয়েছিল তা এখনও পরিষ্কার নয়। জামায়াত নেতারা কি করেছিলেন, তা একদিন নিশ্চয় জানা যাবে। আন্দোলন থেকে সরে আসার পথ তৈরি করতেই দ্রুত অংশ নিতে হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি নির্বাচনে। এর মধ্যদিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন আদালতে জামিন পেয়ে ঘরে ফিরতে পেরেছেন। কিছু কিছু নেতাকর্মীও কারাগার থেকে পর্যায়ক্রমে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু আন্দোলন চলাকালে নাশকতার ঘটনায় একাধিক হত্যা মামলায় হুকুমের আসামি হয়েছেন খালেদা জিয়া। গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে দলের ভবিষ্যৎ নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য-বিবৃতি। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতৃত্ব। বেশির ভাগ নেতাকর্মীর গলায় এখন মামলার ফাঁস। একের পর এক মামলায় চার্জশিট হচ্ছে।
বিএনপি নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় এখন আত্মসমালোচনা করেন। যে জনগণের জন্য আন্দোলন, সে জনগণের তরফে তাদের প্রতি বিরাগ তৈরি হয়েছে পাবলিক পরীক্ষার সময় কর্মসূচি স্থগিত না করায়। টানা অবরোধ ও সপ্তাহে পাঁচ দিন হরতালের কর্মসূচি কোন যুক্তিতেই বাস্তবসম্মত নয় এবং জনগণের পক্ষে সেটা মানা সম্ভব ছিল না। মাসের পর মাস আন্দোলনকে সমর্থন করার সামর্থ্য রাখে না বাংলাদেশের কর্মজীবী মানুষ। এ বিষয়টি অনুধাবনই করতে পারেনি দলটি। সরকার ৫ই জানুয়ারি বিএনপিকে জনসভা করতে না দেয়া ও তাকে অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখার বিষয়গুলো জনগণ ভালভাবে নেয়নি। তেমনি মাসের পর মাস কর্মসূচির মাধ্যমে দেশবাসীকে অবরুদ্ধ করে রাখার বিষয়টিও সমর্থন করতে পারেনি। বিএনপির সমর্থক বা দলটির প্রতি সহানুভূতিশীলদের পক্ষেও তা মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি পেট্রলবোমা ও নানাবিধ সহিংসতায় দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির কারণে এ আন্দোলন বিভিন্ন মহলে কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনোমতেই এরকম সহিংসতার মধ্যে ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচনের আওয়াজ তুলতে পারেনি। অথচ সেটাই ছিল বিএনপির চূড়ান্ত লক্ষ্য। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে  জামায়াতের সঙ্গে জোট ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্তও নিতে পারেনি দলটি। এ ধরনের ভুল কৌশল বিএনপি নির্মূলে সরকারের লক্ষ্য পূরণকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও চলতি শতকের প্রথম দশকে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলো ক্ষমতাকেন্দ্রিক হলেও তাতে জনগণের সমর্থন ও সম্পৃক্ততা ছিল। জেল-জুলুম, হামলা-মামলা উপেক্ষা করে আন্দোলনরত দলগুলোর নেতাকর্মীরা মাঠে তৎপর ছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালের আন্দোলনের চেহারাটি ছিল অনেকটাই ভিন্ন। নেতারা সব আত্মগোপনে, কর্মীদের মিছিলও হাতেগোনা। পৌনে দুমাস ধরে আন্দোলন চলাকালে ঘটেছে একের পর এক নাশকতা। একদিকে যানবাহনে পেট্রলবোমায় মরেছে সাধারণ মানুষ অন্যদিকে ক্রসফায়ারে মরেছে রাজনৈতিক কর্মী। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে- কড়া আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ অচল করা ও বিষয়টি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের নজরে এনে তাদের মধ্যস্থতায় নির্বাচনের পথ বের করাই ছিল বিএনপির লক্ষ্য। কিন্তু উপর্যুপরি নাশকতা সে সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিয়েছে। নাশকতা বিএনপির কাজ নয় বলে দাবি করা হলেও বাস্তবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে দলটির ভাবমূর্তির।
২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারির আন্দোলনের আগে তার সমর্থনে রাজধানীতে নব্বইয়ের দশকের ছাত্রনেতাদের সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে সাবেক ছাত্রনেতারা খালেদা জিয়াকে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের দেখা যায়নি আন্দোলনের মাঠে। কর্মসূচি চলাকালে নেতাদের একাংশ যখন আত্মগোপনে আরেক অংশের নেতারা তখন ছেলেমেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনে ছিলেন ব্যস্ত। নেতৃত্বের একাংশ যখন কারাগারে ধুঁকে মরেছেন, তখন আরেক অংশ সরকারের সঙ্গে সমঝে চলে করেছেন নিরাপদ দিনযাপন। সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক বিষয়ে তাদের আঁতাতের কথা ছড়িয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
বড় কথা হচ্ছে- বিএনপির বিশাল জাতীয় নির্বাহী কমিটির দুই-তৃতীয়াংশ নেতৃত্বের বসবাস ঢাকায়। কিন্তু আন্দোলনে তাদের কোন ধরনের ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল না। ৪ঠা মার্চ ১৬ জন কূটনীতিক খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করতে যান। পরদিন খালেদাকে গ্রেপ্তার করার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। এই ঘটনার পরও পরদিন বিএনপির ১০ জন কর্মীকেও গুলশান এলাকায় দেখা যায়নি। অঙ্গ-সংগঠনগুলোর নেতৃত্বও ছিলেন অলিখিত সমঝোতায় নিরাপদে। এছাড়া সরকারবিরোধী বিগত কয়েক বছরের আন্দোলনে চূড়ান্ত রকমের সমন্বয়হীন ছিল বিএনপির নেতৃত্ব। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বলতে গেলে যোগাযোগই করতে পারেনি তৃণমূল। কিছু ক্ষেত্রে সিনিয়র নেতারা নিজেরাও নামেননি, মাঠে নামতে দেননি তৃণমূলকেও। অবশ্য তখন পরিস্থিতিও ছিল অভাবনীয় রকমের প্রতিকূল। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের উপর যে দীর্ঘমেয়াদে, যে ব্যাপকতায় দেশব্যাপী টানা নিপীড়ন চালিয়েছে তার নজির ১৯৯০ সালের পরের বাংলাদেশে নেই। অনেকের মতে দমন-পীড়নের কারণে বিএনপি নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পারেননি এটা যেমন সত্য, তেমনি বিএনপির কিছু কেন্দ্রীয় নেতাকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবর্ধনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে দ্বিধাহীন চিত্তে খোশালাপে দেখা গেছে।
দৃশ্যত বিএনপির ভেতরেও একা খালেদা জিয়া। গুলশানের আলোচনা সরকারের কানে পৌঁছতে সময় লাগছে খুবই কম। দলের বেশির ভাগ শীর্ষ নেতার বিশ্বাসযোগ্যতাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নিজেরাই নিজেদের সরকারের, কখনও বিদেশের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ সুযোগে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছেন সুবিধাবাদীরা। ফলে দলটির অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা প্রায় সীমিত।
রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টির পাশাপাশি আত্মসমালোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন পথচলার সুযোগ করে দিয়েছিল ওয়ান-ইলেভেন। তৈরি করে দিয়েছিল দুর্নীতিসহ নানাক্ষেত্রে নেতিবাচক ইমেজের নেতৃত্বকে সরিয়ে নতুন ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বকে সামনে আনার পথ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কাজে লাগাতে পারেনি সে সুযোগ। বিশেষ করে বিএনপিকে দেখা গেছে, চরম অদূরদর্শী ভূমিকায়। ওয়ান-ইলেভেনের পর দলের জাতীয় কাউন্সিলে নেতিবাচক ইমেজের নেতারা কেবল তথাকথিত আনুগত্যের জোরে বহাল তবিয়তে থাকার পাশাপাশি পেয়েছেন পদোন্নতি। নেতাকর্মীদের মধ্যে সাধারণত ‘স্যার’ সম্বোধনের রেওয়াজ নেই রাজনীতিতে। কিন্তু বিএনপির রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠ এ সম্বোধনের চর্চা সীমিত। বাকিদের বেশির ভাগই স্যার সম্বোধন না করলে রাগ করেন। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একের পর এক সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্তি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে বলে মনে করা হয়।
রাজনীতির কৌশলের মতো জাতীয় নির্বাচনে দলীয় নমিনেশন দেয়ার ক্ষেত্রেও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত দেখা গেছে বিএনপিতে। চরম সংকটকালেও রাজনীতিকদের চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে ব্যবসায়ী ও আমলাসহ দলের নবাগতরা। দলটি এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, একজন ব্যবসায়ীকে ধানের শীষ প্রতীক উপহার দিতে ছাত্রদলের একজন শীর্ষ নেতাকে আসন ছাড়তে হয়েছে।
৩৬ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে বারবার ষড়যন্ত্রমূলক ভাঙা-গড়া ও উত্থান-পতনের শিকার হয়েছে বিএনপি। জিয়াউর রহমানের জাগোদল ও বিএনপিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন বহুদলীয় ও বহুমতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সেই সঙ্গে রাজনীতি সচেতন বিগ্ধজনদের সমাবেশ। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ষড়যন্ত্রকারী ইঁদুর কাটতে থাকে বিএনপির ঐক্যের জাল। তবে বিএনপির সবচেয়ে বড় ধরনের ভাঙনটি ঘটে অষ্টম সংসদ ও ওয়ান-ইলেভেনের সময়। রাজনৈতিক মতদ্বৈততাকে কেন্দ্র করে দলের প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব প্রফেসর ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রমের মতো সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দল ছাড়েন অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তারা কেবল দলই ছাড়েননি, বিএনপির বিরুদ্ধে নানা প্র্রচারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, দল ছেড়ে যাওয়ার পর তাদের নানা বক্তব্যে। সর্বশেষ আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলের একটি সংস্কারপন্থি গ্রুপ আলাদা তৎপরতা চালান। এসবের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠাকালীন বহু প্রভাবশালী ও সম্ভাবনাময় নেতা বিভিন্ন সময়ে বিএনপি ছেড়েছেন। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার ভাঙা-গড়ার খেলায় জড়িত হলেও তৃণমূল নেতৃত্ব ছিল সবসময় ঐক্যবদ্ধ। বর্তমান রাজনৈতিক দুঃসময়েও সরকারের বিরুদ্ধে দল ভাঙার অপচেষ্টা চালানোর অভিযোগ করছে বিএনপি। দলীয় মহলে গুঞ্জন চলছে দলের ভেতরও কেউ কেউ যুক্ত হয়েছে সে ভাঙনের প্রক্রিয়ায়।

No comments

Powered by Blogger.