দূষিত রক্তের ৮৯ শতাংশে হেপাটাইটিসের জীবাণু

বিভিন্ন রোগজীবাণুর উপস্থিতির কারণে গত এক যুগে যত রক্ত অব্যবহৃত থেকেছে, তার প্রায় ৮৯ শতাংশ ছিল হেপাটাইটিস বি ও সি সংক্রমিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন ২০১৪ বলছে, ২০০১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত দেশের ২০৮টি কেন্দ্র থেকে ৫১ হাজার ২৫৭ ইউনিট রক্ত ফেলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৪০ হাজার ৩১টিতে হেপাটাইটিস বি ও ৫ হাজার ৩০৮টিতে হেপাটাইটিস সি-এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
আজ মঙ্গলবার বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এ উপলক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের প্রধান পুনম ক্ষেত্রপাল সিং বলেছেন, যকৃতে ক্যানসারের ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী হেপাটাইটিস বি ও সি। এই দুই ভাইরাসের মূল উৎস সংক্রমিত রক্ত। অনিরাপদ ইনজেকশন দিয়ে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে রক্ত সংগ্রহ ও রোগীকে দেওয়া হলে হেপাটাইটিস বি ও সি-তে আক্রান্ত হয় মানুষ।
চিকিৎসকেরা বলছেন, হেপাটাইটিস বি-এর সংক্রমণে সাধারণ জন্ডিস থেকে রোগী লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হতে পারে। হেপাটোলজি সোসাইটির হিসাবে বাংলাদেশে ৬৬ লাখ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। যারা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে ভুগছে কিংবা থ্যালাসেমিয়া রোগী এবং যারা বারবার রক্ত নিচ্ছে, তাদের মধ্যে হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্তের হার ৪১ দশমিক ৯ ও ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
হেপাটোলজি সোসাইটির সভাপতি মবিন খান তাঁর ব্লগে লিখেছেন, ‘আমাদের অধিকাংশ রক্তদান কেন্দ্রে রক্ত দেওয়া-নেওয়ার আগে ভাইরাসের পরীক্ষা করা হয় না। আমাদের আশঙ্কা, বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে হেপাটাইটিস সি ছড়াতে পারে।’
রক্ত সঞ্চালন পরিস্থিতি: ডব্লিউএইচও ২০১২ সালে বাংলাদেশের রক্ত সঞ্চালন পরিস্থিতি নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। ১০৯টি কেন্দ্রের ওপর করা সমীক্ষায় দেখা গেছে, রক্ত সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে রোগীকে দেওয়া পর্যন্ত সাতটি ধাপে যে নির্দেশনা মানার কথা, সেটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। জেলা হাসপাতালগুলোর ৬২ শতাংশে দক্ষ জনবল নেই। রক্ত সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের সংকট দেখা দেয় প্রায়ই। অনেক সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওষুধের বাজার থেকে ব্লাডব্যাগ কিনতে বাধ্য হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, সরকারি হাসপাতালগুলো জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে ব্লাডব্যাগ কেনে। বছরে ব্যাগের চাহিদা ছয় লাখ। চাহিদার ১২ শতাংশের ১ শতাংশের জোগান দিতে পারে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান। বাকিটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় বেশির ভাগ সময়ই সংকট থাকে। চেষ্টা করা হয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন আছে—এমন প্রতিষ্ঠানের ব্যাগ কেনার। শতভাগ ক্ষেত্রে সেটা মানা হচ্ছে, এমন নিশ্চয়তা তারা দিতে পারছে না।
রক্তদাতা ও গ্রহীতার নিরাপত্তার জন্য সরকারের ‘ন্যাশনাল সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রাম’ (এসওপি) নামের একটি কর্মসূচি আছে। এর উপ-কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শেখ দাউদ আদনান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে হেপাটাইটিস বি ও সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ও এইচআইভি এইডস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এ নিয়ম সরকারি হাসপাতালগুলোতে পুরোপুরি মানা হচ্ছে।’ তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি খাতে রক্ত সঞ্চালনে কোথাও কোথাও সমস্যা থেকে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক শামিউল ইসলাম বলেন, বেসরকারি খাতে বড় হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর প্রতিটি যদি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ব্লাডব্যাংক চালাত, তাহলে ঝুঁকি অনেকটা কমে যেত। ৮৮টি প্রতিষ্ঠান ব্লাডব্যাংক হিসেবে অধিদপ্তরের সনদ নিয়েছে। এগুলো শুধু রক্ত সংরক্ষণ ও সরবরাহ করে থাকে। নিয়ম না মানায় এ বছর এমন আটটি প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিল করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রকেই নজরদারিতে আনার চেষ্টা চলছে।

No comments

Powered by Blogger.