‘কেউ যেন এভাবে মৃত্যুর দিকে ঝাঁপ না দেয়’ by শরিফুল হাসান

হাতকড়া পরা ও শিকলে বাঁধা ৯৪ বাংলাদেশি। দেশে
ফেরত পাঠানোর আগে গত বৃহস্পতিবার এভাবেই
তাঁদের মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে আনা
হয়। বুধবার রাত ১০টা থেকে গতকাল বেলা সাড়ে
তিনটা পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ১৭ ঘণ্টা শিকলে বন্দী ছিলেন
তাঁরা। গতকাল সন্ধ্যায় তাঁরা দেশে ফেরেন
‘আর কোনো দিন কেউ যেন এভাবে মৃত্যুর দিকে ঝাঁপ না দেয়।’ ধরা গলায় মাদারীপুরের মোহাম্মদ আতিয়ারের এই কথাগুলো শোনাল আর্তির মতো। কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগমুহূর্তে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তাঁর হাতে হাতকড়া ও শিকল।
সাগরপথে মানব পাচারের শিকার আতিয়ার। বন্দিদশা থেকে ফিরছেন নিজ দেশ বাংলাদেশে। তাঁর মতো ভাগ্যবিড়ম্বিত আরও ৯৩ জন একই সঙ্গে ফিরছেন দেশে। সারিতে দাঁড়ানো সবার হাতেই আতিয়ারের মতো হাতকড়া, শিকল। সবার পরনে একই রঙের গেঞ্জি। অনেকের শরীরে নির্যাতনের ও চেহারায় আতঙ্কের ছাপ।
বিশাল ও ঝকঝকে বিমানবন্দরের সঙ্গে বেমানান এই দৃশ্য দেখা যায় গতকাল বৃহস্পতিবার। খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখে আসা এই বাংলাদেশিরা বললেন, হাতকড়া ও শিকল লাগানো হয়েছে গত বুধবার রাত ১০টায় ক্যাম্প থেকে বের করার সময়। এরপর টানা ১১ ঘণ্টার বাসযাত্রা ও বিমানবন্দরে পাঁচ ঘণ্টার অপেক্ষা।
অবশেষে দেশের উদ্দেশ্যে বিমানে ওঠার আগমুহূর্তে খুলল হাতকড়া ও শিকল। বন্দিদশা থেকে মুক্তি মিলল ৯৪ জন বাংলাদেশির। সাগরে ট্রলারে দালালদের নির্যাতন, সহযাত্রীর মৃত্যু, অনিশ্চিত সাগরযাত্রা, উদ্ধারের পর ক্যাম্পে বন্দিত্ব, হাতকড়া—সব পেছনে ফেলে তাঁরা পা রাখলেন নতুন জীবনে।
স্থানীয় সময় গতকাল বেলা সাড়ে তিনটায় তাঁদের বিমানটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ঢাকার সময় সন্ধ্যা ছয়টার আগে তাঁরা দেশে ফেরেন। তাঁদের ৩৬ ঘণ্টা আগে আরও ৯৪ জন বাংলাদেশি দেশে ফেরেন। তাঁরাও সাগরপথে মানব পাচারের শিকার হয়েছিলেন।
গতকাল ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগে মোহাম্মদ আতিয়ার করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘সাগরে ট্রলারে থাকার সময় পানি না পেয়ে প্রস্রাব খাওয়া, চোখের সামনে না খেয়ে একের পর এক সহযাত্রীর মৃত্যু, দালালদের ভয়াবহ নির্যাতন—এসব দেখে জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ নতুন জীবন দিয়েছে। আর কোনো দিন কেউ যেন এভাবে মৃত্যুর দিকে ঝাঁপ না দেয়। তবে সরকারের কাছে অনুরোধ, যারা এভাবে মানুষকে জোর করে, প্রলোভন দেখিয়ে নরকে পাঠাচ্ছে, তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।’
বিমানবন্দরে আলাপকালে দায়ী দালালদের চিহ্নিত করে ধরার উদ্যোগ না থাকায় ক্ষোভ জানান আতিয়ারসহ কয়েকজন। বিমানবন্দরে ঘণ্টা দুয়েক কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। মঙ্গলবার রাতে যে ৯৪ জনকে দেশে পাঠানো হয়, তাঁদের হাতের হাতকড়া খুলে ফেলা হয়েছিল কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে বাস থেকে নামানোর সময়। গতকাল হাতকড়ার সঙ্গে যোগ হলো শিকল, খোলা হলো বিমানে তোলার আগে।
শিকল ও হাতকড়া লাগানোর কারণ জানতে চাইলে বিমানবন্দরে থাকা মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশের উপসহকারী পরিচালক জোসামি মাস্তান যা বললেন তার মানে দাঁড়ায়, ‘আপনাদের দেশের লোককে বলেন এভাবে যেন আর মালয়েশিয়ায় না আসে।’
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম বলেন, তাঁদের তো হাতকড়া পরানোর কথা নয়। বিষয়টি তিনি দেখবেন।
গতকাল বাস থেকে নামানোর পর ৯৪ জনকে হাতকড়া-শিকল লাগানো অবস্থায় বিমানবন্দরের ফুটপাতে বসিয়ে রাখা হলো প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। ক্লান্ত¯অনেকে ফুটপাতেই শুয়ে পড়েন। অনেকের হাত ফুলে লাল হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা বারবার জানতে চাইছিলেন, কখন এগুলো খোলা হবে।
এই বাংলাদেশিদের শিকল ও হাতকড়া পরিয়ে রাখার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা মালয়েশিয়ার বেসরকারি সংস্থা তেনাগানিতা। বিকল্প নোবেলজয়ী এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এজেল ফার্নান্দেজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বাংলাদেশিরা কোনো অপরাধী নয়। তারা মানব পাচারের শিকার। তাদের শিকল ও হাতকড়া পরানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আমরা সরকারকে বলব, এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে। তাদের সঙ্গে যেন মানবিক আচরণ করা হয়।’
গতকাল দেশে ফেরা ৯৪ জনের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জন ছিল শিশু-কিশোর। এদের একজন নরসিংদীর মোহাম্মদ রবিন (১৪) বলল, এলাকার দালাল মোস্তফা তাকে জোর করে ট্রলারে তুলেছিল। কক্সবাজারের উখিয়ার মহিউদ্দিন (১৪) বলল, সেখানকার দালাল আজিজ তাকে বলেছিল মাত্র চার দিনেই মালয়েশিয়া যাওয়া যাবে। কিন্তু তিন মাস সাগরে ভেসে বন্দী থেকেও তার মালয়েশিয়া আসা হয়নি। শেষ পর্যন্ত¯যখন বেঁচে মালয়েশিয়ার উপকূলে ওঠে, তখন তাকে ক্যাম্পে নিয়ে রাখা হয়।
এই ৯৪ জনকে গত ১১ মে লংকাবি উপকূল থেকে আটক করে বেল্লাতি ক্যাম্পে রেখেছিল পুলিশ। এর আগের ৯৪ জনকেও বেল্লাতি ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল।
কক্সবাজারের রামুর সাইফুল ইসলাম (১৫) বলল, তারা পাঁচ ভাই। কাজেই দালাল আবুবকর তাকে বিনা পয়সার মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বললে রাজি হয়। কিন্তু সাগরে নিয়ে নির্যাতন করে তার পরিবারের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করে। এখন তার পরিবার সর্বস্বান্ত।
চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি মাখানো এই কিশোরেরা বলল, বুধবার রাত ১০টায় ক্যাম্প থেকে বাসে তোলার আগে তাদের প্রত্যেককে লোহার পাইপ দিয়ে তিনটি করে বাড়ি দিয়েছে পুলিশ। এরপর সবার হাতে হাতকড়া লাগানো হয়। প্রতি ছয়জনকে আবার শিকলে বাঁধা হয়েছে। একজনকে বাথরুমে যেতে হলে ছয়জনকেই সঙ্গে যেতে হয়েছে।
নরসিংদীর সাইদুল (১৯) নিজের পিঠে নির্যাতনের চিহ্ন দেখালেন। সেদিকে বেশি তাকিয়ে থাকা দায়। সাইদুল বললেন, ট্রলারে ওঠার পর দালালেরা টাকার জন্য এই নির্যাতন করেছে। ফলে সেখানে ঘা হয়ে পচন ধরে গিয়েছিল। তবে এখন দেশে ফিরে সব কষ্ট ভুলে যাবেন।
এই বাংলাদেশিরা জানান, মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে ও জোর করে প্রায় পাঁচ মাস আগে তাঁদের মালয়েশিয়াগামী দুটি ট্রলারে ওঠানো হয়েছিল। তাঁদের মতো মানুষভর্তি আরও ১৮টি ট্রলার ছিল। কিন্তু তাঁদের দুটি ট্রলারই কেবল উপকূলে ভিড়তে পেরেছে। বাকি ১৮টি কোথায় গেছে, তা তাঁরা জানেন না।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র বলেছে, গতকাল ফেরা ৯৪ জনসহ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৩৫৭ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। আজ শুক্রবার ফিরবেন আরও ৩৭ জন। এ ছাড়া পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও প্রায় ২৫০ জন।
এর আগে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। তবে কারও কাছ থেকেই দালালদের নাম জানার চেষ্টা হয়নি বলে তাঁদের কয়েকজন জানান।
গতকাল মালয়েশিয়া থেকে যাঁরা ফিরলেন তাঁদের সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা ৫০ জন দালালের নাম বললেন, যারা তাদের ট্রলারে তুলেছিল। ওই ৫০ জন হলো: বান্দরবানের নুর আলম, আবদুর রহমান, কক্সবাজারের শহিদ আলম, আনিস, বাদশা, শুক্কুর, সুরুজ আলী, বাচ্চু, রামুর আবুবকর, ফরিদ, পেকুয়ার হোসেন, টেকনাফের আবদুল আমিন, আজিজ, সিদ্দিক, মোহাম্মদ রিদওয়ান, চকরিয়ার হাবিব, ঝিনাইদহের রাজ্জাক, সুনামগঞ্জের কাপ্তান, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের হানিফ, নরসিংদীর মোস্তফা, আলমগীর, শফিক, সিরাজুল, আলমগীর, সাইদুর, চুয়াডাঙ্গার বকুল, সিরাজগঞ্জের পাষান আকন্দ, জিন্নাত আলী, ঝন্টু, ফরিদপুরের নগরকান্দার চান মিয়া, জামান, যশোরের রুবেল, মাদারীপুরের সোহেল ও মিজান।
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব মুশাররাত জেবিন বলেন, সাগরপথে নির্যাতন, মুক্তিপণ আর মৃত্যুর যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়া জরুরি। এ জন্য দালালদের চিহ্নিত করে বিচার করা দরকার।

No comments

Powered by Blogger.