আজ ঈদের কেনাকাটা, বাধ্যতামূলক যেন! by মানসুরা হোসাইন

‘রাঙাপরী ৩০, মমতাজ ৩০। আড়াই শ থেইক্যা মাত্র ৩০ টাকা। ৫০ টাকাও না। আজকাই শেষ। আর পাইবেন না। মিস করলেই কিন্তুক শেষ।’-রাজধানীর কারওয়ানবাজারে আজ শুক্রবার বিকেলে ভ্যানের ওপর মেহেদির টিউব সাজিয়ে এভাবেই ক্রেতাদের ডাকাডাকি করছিলেন একজন। বাড়িতে বউ আছে, মেয়ে আছে। ঈদে মেহেদি কিনতেই হবে। আর তা-ই যখন মাত্র ৩০ টাকায় কেনার সুযোগ, হাতছাড়া করছিলেন না অনেকেই।
রাঙাপরী, মমতাজ মেহেদি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৩০ টাকায়। কারওয়ানবাজারে মেহেদি টিউবের ভ্যানকে কেন্দ্র করে ক্রেতাদের ভিড়। ছবি: মানুসরা হোসাইন
কাল শনিবার ঈদ হলে কেনাকাটার জন্য আর হাতে সময় নেই বললেই চলে। নগরীর বিভিন্ন বিপণি বিতান ঘুরে দেখা গেলো আজ যে ক্রেতারা এসেছেন তাঁদের মধ্যে তাড়াহুড়ার ভাব। সব কেনা হলেও মেহেদি তো কেনা হয়নি। আবার সেমাই-পায়েশের জন্য অন্য সব কেনা হলেও পেস্তা-কিসমিস কেনা বাকি। পরিবারের সবার কেনাকাটার পর অনেকে নিজের জুতাসহ অন্যান্য টুকিটাকি কেনাকাটা করছেন। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, কারওয়ানবাজার আর নিউমার্কেটসহ কিছু মার্কেটে আজ নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড়। ভ্যানে বিক্রি করা স্বল্পমূল্যের টিশার্টও কিনছেন অনেকে। আর তরুণীদের শেষ মুহূর্তে মনে হয়েছে নেলপালিশের রংটা ড্রেসের সঙ্গে তেমন একটা ম্যাচ করেনি, অথবা কানের দুলটা মন মতন হয়নি। তাই আবারও একটু ঢুঁ দেওয়া। তবে আজ জিনিসপত্র দেখাদেখির চেয়ে কিনে নেওয়াটাই ভাবছেন শ্রেয়। তাইতো আজ খালি হাতে ফিরছেন না কেউই।
আড়ং, অ্যাপেক্স ও, দেশীদশসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকানেও দেখা গেল চিরচেনা ভিড়। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে মুন ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকে যাঁরা দোকানে ঢুকছেন তাঁরা কিনছেন। বাধ্যতামূলক কেনাকাটা আর কি! আজকে না কিনলে তো আর উপায় নাই।’
নাড়ির টানে অনেকে ঢাকা ছাড়ায় রাজধানী এখন অনেকটাই ফাঁকা। মূলত যাঁরা ঈদে ঢাকায় থাকছেন তাঁরাই আজ কেনাকাটা করছেন। কিন্তু কিছুটা ব্যাঘাত ঘটিয়েছে সকালের এক পশলা বৃষ্টি। আবার জমতে শুরু করে দুপুর ১২টার পর থেকে। শুক্রবার হওয়ায় জুমার নামাজ শেষ করে জায়নামাজ হাতে নিয়েই এলাকার বিভিন্ন দোকানে ঢুঁ মেরেছেন অনেকে।
বুয়ার কাজ করা হাজেরা ছেলেমেয়েদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করছেন কারওয়ানবাজারে। ছবি: মানসুরা হোসাইন
কারওয়ানবাজারে কথা হয় হাজেরা নামের এক বুয়ার সঙ্গে। স্বামী রিকশা চালান। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। পুরো পরিবারের জন্য ঈদের বাজেট তিন হাজার টাকা। হাজেরা জানালেন, তাঁর শাড়ি আছে। তাই এবার আর নিজের জন্য কিছু কিনবেন না। দেড় শ থেকে আড়াই শ টাকা করে পোশাক কিনে দিয়েছেন ছেলে-মেয়েদের। একটি সোনালী রঙের গলার চেইন কিনেছেন। মাথার একটি ক্লিপ কিনে দেওয়ার জন্য বায়না করছে মেয়ে। তাইতো বারবার হাতের মুঠোতে রাখা টাকা গুনে দেখছিলেন।
হাজেরা বলেন, ‘এই দ্যাখেন মাত্র এই কয়টা জিনিস কিনছি, তাতেই ম্যালা টাকা লাগছে।’ বিক্রেতা হাজেরার মেয়ের বায়না করা ক্লিপের দাম হাঁকাচ্ছে ৩৫ টাকা। আপাতত অন্যান্য দরকারি জিনিস কেনার পরই ভেবে দেখবেন এটা কিনবেন কি না। তাইতো সাত বছর বয়সী মেয়ে তার পিছু পিছু হাঁটছে মুখ গোমড়া করে।
যেটাই কিনবেন এক দাম। নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের ভিড়। ছবি: মানসুরা হোসাইন
কারওয়ানবাজারেই কথা হয় নিরাপত্তাকর্মী আশরাফের সঙ্গে। ছুটি মেলেনি তাঁর। দায়িত্ব পালন করতে হবে ঈদের দিনও। রাস্তার পাশে জুতার পসরা সাজানো। নিজের জন্য জুতা পছন্দ করছিলেন সেখানে। রাজশাহীতে বউ-বাচ্চা থাকে। তাঁদের জন্য ঈদের কেনাকাটার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন আগেই।
শেষ দিনে আজ কেনো কেনাকাটা করছেন জানতে চাইলে আশরাফ একগাল হেসে বললেন, ‘আগে সুযোগ পাই নাই।’
কৃষি মার্কেটে আজকের কেনাকাটা প্রসঙ্গে নূরে মদিনা দোকানের মালিক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এই মার্কেটে আল্লাহর রহমত আছে। অন্য মার্কেটে কাস্টমার না থাকলেও কৃষি মার্কেটে থাকবেই। এই মার্কেটে শাড়ি, সালোয়ার, কামিজ আর বাচ্চাদের পোশাক থেকে শুরু করে পাওয়া যায় না এমন কোনো জিনিস নাই। ধনী, দরিদ্র সব ধরনের কাস্টমারের জন্যই জিনিস আছে। চাঁন রাতে সারা রাতই খোলা থাকবে এই মার্কেট।’
জুতা পছন্দ করছেন নিরাপত্তাকর্মী আশরাফ। ছবি: মানসুরা হোসাইন
শহীদুল ইসলাম জানালেন, জাপান গার্ডেন সিটি মার্কেটে তাঁর ভাইয়ের আরেকটি দোকান আছে। নাম ‘জামদানি শাড়িজ’। সব ধরনের ক্রেতার কথা চিন্তা করে জামদানি শাড়ির পাশাপাশি ভারতের ‘এক্সক্লুসিভ’ শাড়িও রাখা আছে। বললেন, ‘সেখানেও আজ ভালো বিক্রি হচ্ছে।’
দেশীয় ফ্যাশন হাউস রঙ-এর কর্ণধার এবং ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বললেন, ‘এখন আর সেভাবে চাঁদ রাত বলতে কিছু থাকে না। ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় মানুষের সংখ্যা কমে যায়। তবে শেষ কেনাকাটা বলে একটা কথা থেকেই যায়। সন্ধ্যার পর ক্রেতার একটু চাপ বাড়বেই। আবহাওয়া আর ওপরওয়ালাকে ওপরই নির্ভর করবে বাকিটা।’

No comments

Powered by Blogger.