জন কেরি বনাম জাভাদ জারিফ

প্রথম দেখায় ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের কড়া সমর্থক জাভাদ জারিফ ও সাবেক ডেমোক্রেটিক মার্কিন সিনেটর, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির মধ্যে খুব একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সকল ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দু’জনই হতে যাচ্ছেন ইতিহাসের অংশ। লম্বা জন কেরি পরেন দামি বিলাসী স্যুট। অপরদিকে, মোহাম্মদ জাভাদ জারিফের পরনে থাকে ঐতিহ্যবাহী কলারবিহীন শার্ট। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি চূড়ান্তের লক্ষ্যে কয়েক মাস ধরে চলা ঝুঁকিপূর্ণ ও দীর্ঘ সমঝোতা প্রক্রিয়ায় দু’ জনই নিজেদের প্রমাণ করেছেন দৃঢ়চেতা ও বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ হিসেবে। কেরির ভাঙা পা-ও তাকে শ্লথ করতে পারে নি। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের সমপর্কটা বেশ উষ্ণই বলা চলে। একে অপরকে নামের আদ্যাক্ষরে ডাকেন জন ও জাভাদ। মাঝেমাঝে কৌতুক করতে দেখা যায় তাদের। কিন্তু নিজেদের মধ্যকার সমপর্কটা অনেকটাই স্বার্থের জালে আবদ্ধ। এটি হয়তো খুব একটা আশ্চর্যজনক বিষয়ও নয়। কেননা, ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ দু’টির মধ্যে কোন কূটনৈতিক সমপর্ক ছিল না। এছাড়া, প্রায়ই দু’দেশ কিছু ভারি ইস্যু নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে আছে। যেমন, মধ্যপ্রাচ্যের সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি ইরানের সমর্থন দানের অভিযোগ। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চলা আলোচনার দুই মূল ব্যক্তিকে নিয়ে এমনটি লিখেছে বার্তা সংস্থা এএফপি। অন্যদিকে এএফপি লিখেছে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা হলেন সঠিক সময়ে বেছে নেয়া সঠিক দু’জন মানুষ। ইরানের পারমাণবিক উচ্চাশা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিশ্ব সমপ্রদায় উদ্বিগ্ন। এমন সময়ই তারা দু’জন একত্রিত হলেন। এমনকি ইতিমধ্যেই তাদেরকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার সম্ভাবনাও উচ্চকিত হচ্ছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সীমাবদ্ধ করতে মঙ্গলবার চূড়ান্ত হওয়া চুক্তিটির ফলে এমন অনুমান এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫৫ বছর বয়সী জাভাদ জারিফকে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। খুব দ্রুতই তাকে ম্যান্ডেট দিয়ে পারমাণবিক আলোচনা অব্যাহত রাখার কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ও অনর্গল ইংরেজিভাষী জারিফ তার দেশের ইসলামী বিপ্লবের পুরোনো সমর্থক। আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকেই অন্যদের তুলনায় এগিয়ে ছিলেন জারিফ। জাতিসংঘে তিনি ২০ বছর কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে ২০০২ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও কাজ করেন তিনি। বলতে গেলে জাতিসংঘে ইরানের প্রতিচ্ছবিই ছিলেন জাভাদ। অপরদিকে, আমেরিকান কর্মকর্তাদের কাছে তাদের ইরানি প্রতিপক্ষদের সমপর্কে তেমন ধারণা ছিল না। অবশ্য, সিনেটর হিসেবে জন কেরি ২০১২ সালে ওমানে অনুষ্ঠিত গোপন মার্কিন আলোচনার অংশ ছিলেন। মোহাম্মদ জারিফকে ‘ব্রিলিয়ান্ট’ আখ্যা দিয়ে ইরান বিশেষজ্ঞ সুজানে মালোনি বলেন, আমেরিকানদের চোখে সন্দেহপূর্ণ অনেক নীতি আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করার দক্ষতা তার আছে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, তবে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, তিনি যতটা ইরানি, তার চেয়েও বেশি আমেরিকান। সুজানের ভাষায়, জাভাদ জারিফ ইসলামী রিপাবলিকের খুবই অনুগত একজন মানুষ। তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ে এমন উচ্চ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন, এটি কোন দুর্ঘটনা নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জারিফের দীর্ঘ সমঝোতার বিষয়টি তার নিজ দেশের উগ্রবাদী শিবির ভালো চোখে দেখছে না। তৎকালীন রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ তাকে বহিষ্কারও করেছিলেন। এরপর ছয় বছর পড়াশুনায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হওয়া প্রেসিডেন্ট রুহানি তাকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন। অত্যন্ত ধার্মিক জাভাদ নিয়মিত নামাজ পড়েন। এ কারণে ভিয়েনায় বিশ্বশক্তিসমূহের সঙ্গে তার আলোচনায় ব্যাঘাতও ঘটেছে। নামাজ থেকে ফিরে তাকে বলতে শোনা যায়, আমি একমাত্র প্রকৃত শক্তিকেই ভয় পাই। তবে ধার্মিক হলেও, নিজ দেশের উগ্রপন্থিদের সন্দেহ, জাভাদ পশ্চিমাদের ব্যাপক ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু এরপরও এপ্রিলে সুইজারল্যান্ডের লুসানের আলোচনা শেষে রূপরেখা চুক্তির পর নিজ দেশে বীরোচিত সংবর্ধনা পেয়েছেন তিনি।
ধার্মিক ক্যাথোলিক জন কেরির জন্য প্রায় ২ বছরের আলোচনা শেষে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি রোধে চুক্তি চূড়ান্ত করাটা ইতিহাস-সৃষ্টিকারী বিজয়। বহুদিনের আরাধ্য মধ্যপ্রাচ্য শান্তি চুক্তি নিয়ে বাস্তবতাহীন ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর এ চুক্তি তার জন্য আরও বড় কিছু। সুজানে মালোনি বলেন, দুই পুরোনো প্রতিপক্ষের জন্যই এ যুগান্তকারী চুক্তিটি ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে এক বিজয়।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে প্রথম সাক্ষাৎ হয় জারিফ ও কেরির। হাস্যোজ্জ্বল জারিফ সেবার সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। তার মুখ থেকে সে হাসি আর কখনও বিলুপ্ত হয়নি। এরপর থেকে, মনোমুগ্ধকর এবং বিশুদ্ধ ইংরেজিভাষী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। তবে আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানালেন, তিনি মাঝে মাঝে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে যান। আবার যখন এমন কিছু নিয়ে তাকে বেশি চাপ দেয়া হয়, যা তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না বলে মনে করেন, তখন তিনি রেগেও যান। যে গুটিকয়েক ইরানি কর্মকর্তার টুইটার অ্যাকাউন্ট আছে, তাদের মধ্যে জারিফ অন্যতম। তবে ইরানে টুইটার নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বার্তা দিতে তিনি টুইটার ও ইউটিউব বেশ কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.