আসামিদের ধরিয়ে দিল জনতাই

সিলেটের শিশু সামিউল আলম (রাজন) হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ধরপাকড়ে জনতাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। অভিযুক্ত প্রধান আসামিসহ চারজনকেই পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ায় মূল ভূমিকা রেখেছে সাধারণ মানুষ। এতে অবদান আছে দুই অভিযুক্তের মায়েরও। এদিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে গতকাল বুধবার দুলাল আহমদ নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকালই মামলার তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) দেওয়া হয়েছে। নতুন একটি ভিডিও চিত্রে সামিউলকে ২১ সেকেন্ডে ১২টি চড় মারার দৃশ্য দেখা গেছে। সামিউল হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত কামরুল ইসলাম সৌদি আরবে পুলিশ হেফাজতে আছে। তাকে জেদ্দার স্থানীয় বাংলাদেশিরা আটক করে পুলিশে দেন। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৮ জুলাই সামিউলকে হত্যার পর লাশ গুম করার চেষ্টার সময় জনতা প্রধান আসামি মুহিত আলমকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। এরপর গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় নির্যাতনকারীদের অন্যতম চৌকিদার ময়না মিয়াকেও জনতা পুলিশে দেয়। ময়নার মা ছমিরুননেছা ছেলের অবস্থান সম্পর্কে স্থানীয় টুকেরবাজার ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য এনামুল হোসেনকে জানালে তিনি পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। এনামুল হোসেন জানান, ময়নাকে মূলত তাঁর মা-ই ধরিয়ে দিয়েছেন।
কামরুল ইসলাম, মুহিত আলম, ময়না মিয়া, দুলাল আহমদ
জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন জানান, গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে সিলেট সদর উপজেলার শেখপাড়া গ্রাম থেকে দুলালকে (৩০) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুলালের মা রাজিবুন খাতুনের প্রচেষ্টায় এ গ্রেপ্তার সম্ভব হয়েছে বলে তিনি জানান। মামলার প্রায় সব আসামিকে এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সামিউল হত্যার পর থেকে পলাতক ছিলেন দুলাল। গত মঙ্গলবার রাত একটায় তিনি নগরের কানিশাইল এলাকায় তাঁর বোনের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। এটি জানতে পেরে মা রাজিবুন তাঁর ছেলেকে গতকাল দুপুরে শেখপাড়া এলাকার বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর আড়াইটার দিকে এলাকাবাসীসহ তিনি ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এ সময় রাজিবুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার পোয়া (ছেলে) যদি দুষি হয়ে থাকে, আপনার ফাঁসি দিলাউক্কা। আমার কুনু দুঃখ নাই। ওউ মায়ের (সামিউলের মা) বুক খালি হইছে, ছোট একটা ছেলে মরছে, এতে আমার দুঃখ লাগতাছে। আমার বাচ্চাও আমি কুরবানি দিলাম।’
সামিউল হত্যায় গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন: প্রধান আসামি মুহিতের স্ত্রী লিপি বেগম, শ্যালক ইসমাইল হোসেন আবলুচ (৩২), প্রত্যক্ষদর্শী আজমত উল্লা ও ফিরোজ আলী। এজাহারভুক্ত আসামি মুহিত-কামরুলের ভাই হায়দার আলী ওরফে আলী এখনো পলাতক। এর মধ্যে মুহিত, ইসমাইল ও ময়নাকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
আসামি গ্রেপ্তারে জনতার ভূমিকা প্রসঙ্গে সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ বলেন, ‘২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র হত্যার ঘটনায় এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় আসামিদের আমরা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছিলাম। এবার শিশু হত্যার ঘটনায় সেই বোধ যেন আরও প্রবলভাবে জাগ্রত হয়েছে। তাই অভিযুক্তদের মায়েরাও তাঁদের সন্তানদের পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষ আসামিদের গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করছে, এটি একটি ইতিবাচক।’
মামলা ডিবিতে স্থানান্তর: সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার কামরুল আহসানের নির্দেশে সামিউল হত্যা মামলাটি গতকাল দুপুরে মহানগর ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। মামলাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে মহানগর পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন ডিবির পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার।
এদিকে গতকাল বেলা তিনটায় সিলেটের জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে এক মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে পুলিশ কমিশনার সামিউলের খুনিদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।
সভায় পুলিশ কমিশনার জানান, সামিউলের হত্যাকাণ্ডে আটজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। এজাহারভুক্ত চার আসামির মধ্যে একজন পলাতক আছেন। তাঁকে দ্রুতই গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ। এ ছাড়া সৌদি আরবে আটক কামরুল ইসলামকে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনতে যোগাযোগ শুরু হয়ে গেছে।
আরেকটি ভিডিও চিত্র: সামিউলকে নির্যাতনের প্রথম ভিডিও চিত্রটি ছিল ২৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের। নির্যাতনের দ্বিতীয় পর্যায়ে সামিউলকে একটি বিপণিবিতানের পেছনে গাড়ির গ্যারেজে নিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সেখানে চলে আরেক দফা নির্যাতন। মোট ১ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের ওই ভিডিও দৃশ্যে চৌকিদার ময়না মিয়া ২১ সেকেন্ডে ১২টি চড় মারেন সামিউলকে।
ভিডিও দৃশ্যে দেখা গেছে, দুই হাত দিয়ে ময়নার চড় খেয়ে সামিউল চিৎকার করেও কাঁদছিল। তবু ক্ষান্ত হচ্ছিলেন না ময়না। তখন আশপাশে কামরুল ইসলাম ছাড়াও আরও তিনজন ছিলেন। ময়না তাদের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘মারো, যে যেভাবে পারো মারো, কম্পিটিশন করি মারো...!’
নতুন এই ভিডিও দৃশ্যের শুরুতে কামরুল রোলার দিয়ে পেটান সামিউলকে। এরপর ময়না দুই হাতে চড় দিতে থাকেন। কটূক্তি করতে করতে ভিডিও চিত্রের এক মিনিট তিন সেকেন্ড থেকে ২৪ সেকেন্ড পর্যন্ত থেমে থেমে সামিউলকে চড় দেন ময়না। এরপর সামিউল পানি খাওয়ার আকুতি জানায়। সামিউলের সামনে তখন একটি পানির বোতল রেখে লোভ দেখানোও চলে কিছুক্ষণ। দূর থেকে বলা হয়, ‘হা কর...!’। মুখে দূর থেকে পানি দেওয়া হচ্ছিল, সামিউল খাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিল। এতে করে পানি মুখে না পড়ে পরনের গেঞ্জিতে গিয়ে পড়ায় একপর্যায়ে সামিউলকে অনেকটা আঁচল পাতার মতো করে গেঞ্জির মধ্যে পানি দেওয়ার আকুতি জানাতে দেখা গেছে।
প্রথম ভিডিওচিত্রে সামিউল ‘পানি খাওয়াও রে-বা!’ বলে আকুতি জানালে ‘পানির বদলা ঘাম খা’ বলে নির্যাতনকারীদের একজন।
সাত দিনের রিমান্ডে ময়না: চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়নাকেও (৩৫) রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গতকাল বেলা দুইটার দিকে সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ময়নাকে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. রহমত উল্লাহ জানান, আদালত শুনানি শেষে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গত বুধবার খুঁটির সঙ্গে সামিউলকে (১৩) বেঁধে রোলার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নির্যাতনকারীরাই সামিউলকে নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ধারণ করে। সামিউলের লাশ ফেলতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়েন মুহিত আলম (৩৫)। এ ঘটনায় সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। প্রথম ভিডিও চিত্রের সূত্র ধরে গত রোববার প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ‘নির্মম পৈশাচিক!’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
‘হিংস্রতাকে দমন করে মনুষ্যত্বের জয় হোক’ স্লোগানে শিশু সামিউল হত্যার প্রতিবাদে গতকাল রাতে নোয়াখালীতে মোমবাতি হাতে মানববন্ধন করে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ছবিটি শহরের টাউন হল মোড় থেকে গত রাত আটটায় তোলা l প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.