‘সুখ না পেয়েই খুন করি’ by ওয়েছ খছরু

‘স্বামী খলিলের কাছে সুখ না পেয়েই দা দিয়ে গলা কেটে খুন করেছি। অসহ্য হয়ে রাতের আঁধারে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে খুন করি। এরপর রক্তমাখা কাপড়-চোপড় বাথরুমে ভিজিয়ে রাখি।’ এভাবেই স্বামী খলিলকে খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে ঘাতক স্ত্রী ফাতেমা বেগম। খুনের ঘটনার পরপরই তার কথাবার্তায় ও আচরণে সন্দেহ দেখা দিলে পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। প্রথমে সে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খুলেনি। উল্টো পুলিশ ও সাংবাদিকদের ধমকায়। শেষে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর সে পুলিশের কাছে মুখ খুলে। পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে খুনের ঘটনা স্বীকার করার পর ফাতেমাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাবলীগ জামাতের নিবেদিত কর্মী সিলেটের ইব্রাহিম আবু খলিল। বাসা সিলেট নগরীর সওদাগরটুলায়। বাসা নং এক। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের ঠিক পেছনেই ওই বাসার অবস্থান। অনুরাগ হোটেল মোড় থেকে চারাদিঘিরপাড় রাস্তায় ঢুকলেই ডানপাশের প্রথম বাসাটির মালিক ইব্রাহিম আবু খলিল। তার বয়স আনুমানিক ৫৫ বছর। সওদাগরটুলায় রয়েছে তার কোটি টাকার সম্পত্তি। গলিপথের একটি মার্কেটের মালিকও তিনি। বাসা ভাড়া ও মার্কেট ভাড়া থেকেই চলতো তার সংসার। এ কারণে তিনি কয়েক বছর ধরে তাবলীগ জামাতের দাওয়াতি কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন। নিহতের পুত্র সাজিদ গতকাল পুলিশের হাতে আটক হওয়ার আগে জানিয়েছেন, প্রায় আড়াই মাস তাবলীগ জামাতের সঙ্গে ভারতে অবস্থান করছিলেন ইব্রাহিম খলিল। কয়েক দিন আগে তিনি দেশে ফিরেন। এরপর রোববার চলে আসেন বাসায়। প্রতিদিনের মতো গতকাল রাতে সবার সঙ্গে ভাত খেয়ে নিজ কক্ষেই শুয়ে পড়েন ইব্রাহিম খলিল (৫৫)। নিজ কক্ষের গ্রিল দেয়া জানালা খুলে রেখেই তিনি ঘুমাতেন। গতকালও জানালা খোলা রেখে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। প্রতিদিনের মতো গতকাল ভোরে আর ফজরের নামাজে যাননি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিতা ঘুম থেকে না ওঠায় তারা খোঁজ করেন। এ সময় ঘরের জানালা দিয়ে দেখেন তার পিতার মরদেহ পড়ে আছে খাটের নিচে। এদিকে, খবর পেয়ে সকাল ১০টার দিকে সিলেটের কোতোয়ালি থানা পুলিশ সওদাগরটুলাস্থ ওই বাসায় যায়। পুলিশ গিয়ে দেখে খাটের নিচে ইব্রাহিম আবু খলিলের মরদেহ পড়ে আছে। লাশের গলা দা দিয়ে কাটা। এবং একটি বালিশ লাশের মুখের উপর রাখা। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে। পুলিশ প্রথমে বাসার ভেতরে পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। সাংবাদিকরাও তাদের সঙ্গে কথা বলতে যান। এ সময় ইব্রাহিম আবু খলিলের স্ত্রী পুলিশ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেন। এ সময় মহিলা পুলিশের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও পুলিশ কোন তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি। তবে, নিহত ইব্রাহিম খলিলের স্ত্রীর কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্নতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া স্বামীর খুনের ঘটনায় তিনি শোকাহত হওয়ার পরিবর্তে ছিলেন রাগান্বিত। এদিকে, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ নিহত খলিলের স্ত্রী ফাতেমা বেগম ও  ছোট ছেলে সাজিদকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে পুলিশ বেশ কয়েক দফা মা ও ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ফাতেমা বেগম খুনের দায় স্বীকার করে। জানায়, ‘স্বামী ইব্রাহিম আবু খলিলের কাছে সে সুখী ছিল না। এছাড়া, পরিবারের প্রতি তার নজর ছিল না। তাবলীগ জামাতের সঙ্গে সে বাইরে বাইরে দিন কাটাতো। এ কারণে তাকে খুন করেছি।’ সে জানায়, আমি একাই খুন করেছি। দা দিয়ে গলা কেটে খুন করি।’ এসময় পুলিশের কাছে ফাতেমা জানায়, খুনের সঙ্গে তার সন্তানরা জড়িত নয়। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মিডিয়া মো. রহমতুল্লাহ জানিয়েছেন, পারিবারিক কারণেই ফাতেমা বেগম তার স্বামীকে খুন করেছে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। একাই দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করে বলে জানায়। এ কারণে পুলিশ গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের জন্য তাকে আদালতে নিয়ে যায়।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি সোহেল আহমদ আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের জানান, কিছু জটিলতায় তার ১৬৪ ধারা জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়নি। আরও জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। এ কারণে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করা হবে বলে জানান তিনি। পারিবারিক সূত্র জানায়, তাবলীগ জামাতের কাজ শেষে গত রোববারই দেশে ফেরেন ইব্রাহিম খলিল। সওদাগরটুলায় তার রয়েছে বিশাল ভূসম্পত্তি। তার বাসার সামনে রয়েছে একটি মার্কেট। এই মার্কেটের আয় দিয়ে সংসার এবং তাবলীগে যাবার ব্যয় নির্বাহ করেন। তিনি যে রুমে ঘুমাতেন ওই রুমের দরজা সব সময় খোলা থাকতো। রোববার রাতেও এর ব্যত্যয় হয়নি। রাতে খাবার দাবার  শেষে তিনি তার রুমে, স্ত্রী এক রুমে এবং ছোট  ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী সাজিদ আলাদা আরেকটি রুমে ঘুমাতে যায়। এছাড়া, তার বড় দুই ছেলে মাওলানা হুজায়ফা ও সানজিদ বর্তমানে তাবলীগের কাজে সিলেটের বাইরে রয়েছে। সূত্র জানায়, ইব্রাহিম খলিল  ধোপাদিঘীরপার মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করতেন। তবে, সোমবার ফজরের নামাজে তিনি হাজির হননি। সোমবার সকাল ১০টার দিকে বাবার রুমে গিয়ে পিতার রক্তাক্ত  দেহ দেখে চিৎকার দেয়। ইব্রাহিম খলিল মোট তিনটি বিয়ে করেছেন। এর মধ্যে এক স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। অন্য স্ত্রী বসবাস করেন শহরতলীর পীরের বাজার এলাকায়। এ নিয়েও স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধ চলছিলো ইব্রাহিম খলিলের। পুলিশ জানিয়েছে, এ খুনের সঙ্গে আরও একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে। সেটিও তদন্ত করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.