যৌন হয়রানিতে চার বছরে ৯৯ নারীর আত্মহত্যা

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বলছে, গত চার বছরে যৌন হয়রানির শিকার ৯৯ নারী আত্মহত্যা করেছে। যৌন হয়রানিতে বাধা দেওয়ায় লাঞ্ছিত হয়েছেন দুই হাজারের অধিক নারী ও ৪৮৯ জন পুরুষ। আজ মঙ্গলবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে এ তথ্য দেওয়া হয়।
‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অ্যান্ড রাইটস অব উইমেন ইন পাবলিক প্লেসেস’ শীর্ষক সেমিনারটির আয়োজক ছিল ব্র্যাক স্কুল অব ল। অনুষ্ঠানে অধিকারকর্মী সামিয়া ইসলাম শীর্ষ ১২টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য উপস্থাপন করেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তিনি জানান, এই চার বছরে ১১ থেকে ১৫ বছরের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছে। যৌন নিপীড়কেরা মেয়েদের হাত বা ওড়না ধরে টানার মধ্যেই থেমে থাকেনি, ধর্ষণ ও অপহরণের হুমকিও দিয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম বলেন, যৌন হয়রানির আশঙ্কায় ঘরে বসে না থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। নারীরা যত বেশি বাইরে বেরিয়ে আসবে, যৌন হয়রানির আশঙ্কা তত কমবে। তিনি আগামী বছর নববর্ষের অনুষ্ঠানে আরও বেশি সংখ্যায় নারীদের বেরিয়ে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাহিমা নাসরিন পয়লা বৈশাখের ঘটনায় কোনো কোনো মানবাধিকার সংগঠনের ভূমিকায় ব্যথিত হয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘খ্যাতনামা ব্যক্তি ও কোনো কোনো সংগঠন এমন ভাব করেছে, যেন তারা বোবা, কালা ও অন্ধ।’ তিনি আরও বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি হাইকোর্ট নির্দেশিত যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা থাকত, তাহলে যৌন হয়রানির ঘটনা কমে আসত।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে আলোচকেরা বলেন, নারী-পুরুষের সহজ-স্বাভাবিক সম্পর্কে বাধা না দিয়ে সেটিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। এতে করে নারী ও পুরুষ দুই পক্ষই একে অন্যকে সম্মান দিতে শিখবে। তাঁরা আরও বলেন, যেকোনো নির্যাতনের ঘটনায় নারীদের ওপর দোষ চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে কখনই সমস্যার সমাধান হবে না।
নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির শিকার একাধিক নারী
আপডেট: ১৫এপ্রিল, ২০১৫ > বাংলা নববর্ষের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন কয়েকজন নারী। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে এ ঘটনা ঘটে।
নিপীড়নকারীদের ঠেকাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন শাখার সভাপতি লিটন নন্দীর হাত ভেঙেছে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে এই ঘটনা জানানো হলেও তাঁরা যথাসময়ে ব্যবস্থা নেননি।
ঘটনার প্রতিবাদে আজ বুধবার ক্যাম্পাসে মিছিল-সমাবেশ করেছে ছাত্র ইউনিয়ন ও প্রগতিশীল ছাত্রজোট। তারা অভিযোগ করেছে, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বহীনতার কারণেই যেকোনো উৎসবের দিন এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তারা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা দেখে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা নতুন বছর উপলক্ষে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় ছিল। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে শাহবাগ থেকে টিএসসি আসার পথে তাঁরা কয়েকজন দেখেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে ৩০-৩৫ জনের একদল যুবক বেশ কয়েকজন নারীকে যৌন হয়রানি করছে। তারা কারও কারও শাড়ি ধরে টান দিচ্ছিল। কয়েকজনকে তারা বিবস্ত্রও করে ফেলে। এ সময় সেখানে বাধা দিতে গেলে ওই যুবকদের ধাক্কায় তিনি পড়ে যান এবং তাঁর হাত ভেঙে যায়।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিটন নন্দী বলেন, ‘এ দৃশ্য বর্ণনা করা যায় না। আমি আমার পাঞ্জাবি খুলে এক নারীকে দিয়েছিলাম। আরেকটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ওই যুবকেরা ভিড়ের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ধরে এই ঘটনা ঘটাচ্ছিল। আমরা পুলিশ ও প্রক্টরকে ঘটনা জানালেও তারা কেউ যথাসময়ে আসেনি। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা পরে প্রক্টরের কার্যালয়ে গিয়ে দেখেন, তিনি কম্পিউটারে গেমস খেলছেন।’
ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী গেটে যখন এই ঘটনা ঘটছিল, তখন সেখানে মাত্র দুজন পুলিশ ছিল। টিএসসির ডাচ-বাংলা বুথের দিকে বেশ কয়েকজন পুলিশ ছিল। আমরা তাদের এগিয়ে আসতে বললে তারা তখন রাজি হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে আমরা দুজনকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ পরে তাদের ছেড়ে দিয়েছে বলে জানতে পারি।’
গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় যেখানে খুন হন, তার পাশেই সোহরাওয়ার্দী গেটে এ ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্র অভিযোগ করেছেন, সোহরাওয়ার্দী গেট এবং এর ভেতরে প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায়ও প্রথম বর্ষের কিছু ছাত্র নিয়মিতই নারীদের লাঞ্ছিত করে। এসব ব্যাপারে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও এসব প্রতিরোধে এগিয়ে আসা উচিত।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা বলেন, ঘটনাস্থলে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ছিল বলে পুলিশ দাবি করেছে। কাজেই সেগুলো দেখে যেন দ্রুত দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলী বলেন, ‘ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা আমাকে খবর দেওয়ার পরপরই আমি পুলিশকে সোহরাওয়ার্দী গেট বন্ধ করতে এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। পরে পুলিশ সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে বলে আমি জেনেছি। আমরা পুলিশকে বলেছি সিসি টিভির ফুটেজ দেখে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) বিভাগের জাহাঙ্গীর আলম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ এ ব্যাপারে বিধিমতো ব্যবস্থা নেবে।
ক্যাম্পাসে মিছিল, সংবাদ সম্মেলন: যৌন নিপীড়নের এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এবং জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে আজ ক্যাম্পাসে মিছিল-সমাবেশ করেছে ছাত্র ইউনিয়ন ও প্রগতিশীল ছাত্র জোট। পরে দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্র ইউনিয়ন। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক জি এম জিলানী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও মিলন চত্বরে পুলিশের অবস্থানের কাছাকাছি জায়গায় এই ঘটনা ঘটে; যেখানে পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও সিসি ক্যামেরা ছিল। তারপরেও পুলিশ যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি।’
জি এম জিলানী বলেন, বর্ষবরণের দিন মানুষজন যেন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে সে কারণে তাঁরা প্রক্টরের সঙ্গে দেখা করে ক্যাম্পাসে পয়লা বৈশাখের দিন সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ এবং ফুটপাতে দোকান বসতে না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই অবাধে গাড়ি চলতে ও ফুটপাতে দোকানপাট বসতে দেওয়া হয়। এর ফলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ জনসাধারণের চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। ভবিষ্যতে যেকোনো উৎসবের দিনে এমন পরিস্থিতি এড়াতে আগেই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.