ক্যামেরনের ফিরে আসা by কামাল আহমেদ

ডেভিড ক্যামেরন
৮ মে, শুক্রবার দুপুরে লন্ডনের কিংস ক্রস স্টেশন থেকে এজওয়্যারের পথে নর্দার্ন লাইনের টিউবে হঠাৎ করেই একজনের ভিক্ষার আবেদন। মাঝবয়সী পুরুষটির আকুতির বিষয় ছিল—পেটের খিদে মেটানোর জন্য সাহায্যের মিনতি। পাতালরেলের ওই বগিটির সব আসনেই ছিল যাত্রীতে ভরা। একজন বয়স্ক মহিলা কিছু পয়সা দিলেন তাকে এবং জানতে চাইলেন শুধু কি খাবার জুটলেই হবে? তোমার কি মাথা গোঁজার ব্যবস্থা আছে? কথার পিঠে কথা গড়াল কিছুক্ষণ। ভিক্ষাপ্রার্থীর যে কথায় দয়ালু যাত্রী মাথা নাড়ালেন তার বাংলা তরজমা দাঁড়ায় এ রকম, আমাদের এই ভোগান্তি আরও পাঁচ বছর বাড়ল। পাঁচ বছরের কৃচ্ছ্রে ক্লিষ্ট স্বল্প আয়ের কর্মজীবী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে এই নির্বাচনের ফল যে কোনো আশার আলো দেখাচ্ছে না, তারই প্রতিফলন পাতালরেলের এই সংলাপ। নির্বাচনের সব আসনের ফলাফল তখনো আসেনি। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত হয়ে গেছে যে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা, ডেভিড ক্যামেরন আরও পাঁচ বছর সেখানে থাকার অধিকার অর্জন করেছেন। তা–ও আবার শুধু নিজের দলের সাফল্যের কারণে। যার মানে হচ্ছে অন্য কারও সঙ্গে পদে পদে আপসরফার প্রয়োজন হবে না।
অথচ ভোটের ফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যজুড়ে ছিল অজানা উত্তেজনা। বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন তাঁর সরকারি বাসভবনে ফিরে আসার যে ভিডিওচিত্র বিবিসির রাতের খবরে দেখানো হলো তাতে সেখানকার কর্মচারীদের চেহারাতেও বিস্ময়ের ছায়া স্পষ্টতই ধরা পড়ে। বিবিসির সাবেক রাজনৈতিক সম্পাদক এন্ড্রু মার ভোট গণনার রাতেও অক্সফোর্ডশায়ারে ডেভিড ক্যামেরনের নির্বাচনী শিবির থেকে জানান, বুথ-ফেরত জরিপের ফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত সেখানকার আবহ ছিল নির্জীব। কিন্তু রাত ১০টার পর সেখানে আলোর ঝলকানি দেখা দেয়।
নির্বাচনী অনিশ্চয়তায় যাতে কোনো অচলাবস্থা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ঐতিহ্য অনুসরণ করে সরকারিভাবে আমলারা বিকল্প প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন কয়েক মাস আগে থেকেই। ডাক পড়ে সাবেক ডাকসাইটে মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্যার গাস ও ডনেলের। স্যার গাস ব্লেয়ার, ব্রাউন ও ক্যামেরন এই তিন প্রধানমন্ত্রীর আমলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন এবং সরকারি আইনকানুন ও আচারবিধির বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার কারণে প্রশাসনে তাঁকে তাঁর নামের তিন আদ্যক্ষর জিওডি—গড বলে ডাকা হতো। নির্বাচনে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে করণীয় কী হবে সেই নির্দেশনা প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু সেগুলোর কোনো কিছুরই প্রয়োজন হয়নি। প্রায় দুই যুগের মধ্যে ক্যামেরন প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় মেয়াদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যবধান বাড়িয়ে পুনর্নির্বাচিত হলেন।  এই ফলাফল তাই শুধু অপ্রত্যাশিত নয় বরং, বলা হচ্ছে সবাইকে স্তম্ভিত করে দেওয়া ফল।
কীভাবে এবং কেন এমনটি ঘটল? প্রথমত, প্রচারকৌশল এবং টাকার জোর। কনজারভেটিভ পার্টি তার প্রচারকৌশল ঠিক করা এবং প্রচারণার সার্বিক দেখভালের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে বছর খানেক আগে ভাড়া করে আনে লিন্টন ক্রসবিকে, যিনি নির্বাচনী প্রচারণায় একজন সুদক্ষ কারিগর। অস্ট্রেলিয়াতেও কনজারভেটিভ পার্টির বিজয়ের কৃতিত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়। মি ক্রসবি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর নেতিবাচক প্রচারকৌশলে বিশ্বাসী। সুতরাং, ঠিক করা হয় যে ব্রিটেনের অর্থনীতি পরিচালনায় এড মিলিব্যান্ড এবং লেবার পার্টিকে যে বিশ্বাস করা যায় না, সেই বিষয়টি প্রচারণায় তুলে আনা হবে। কেননা, যে মন্দার কারণে ব্রিটেনকে কৃচ্ছ্রের পথে হাঁটতে হয়েছে, সেই মন্দা ঘটেছিল যখন লেবারই ছিল ক্ষমতায়। তবে এই প্রচারণায়ও যখন কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছিল না, তখন অন্য যে বিষয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর পথ বেছে নেওয়া হয়, তা হলো লেবার পার্টি জিতলে স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের হাতে ব্রিটেন জিম্মি হয়ে পড়বে। কৌশল হিসেবে আরও বেছে নেওয়া হয় লেবার পার্টির সেসব আসনগুলো, যেখানে গত নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান ছিল কম সেগুলোতে প্রচার ব্যয় বাড়িয়ে আরও শক্তি নিয়োগ করার। একইভাবে তারা তাদেরই মিত্র লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের আসনগুলোতেও নজর দেয়, যাতে করে সেগুলোও দখলে নেওয়া যায়। উভয় ক্ষেত্রেই কনজারভেটিভ কৌশল সফল হয়। তার কারণ, অফুরন্ত নির্বাচনী তহবিল। গার্ডিয়ান-এর হিসাবে লেবার পার্টির চেয়ে ১০ গুণ বেশি তহবিল জোগাড় করেছিল কনজারভেটিভরা।
অবশ্য এসব কৌশলই যে মি ক্যামেরনের বিজয় নিশ্চিত করেছে তা বলা যাবে না। এর বাইরে রাজনৈতিক পরিস্থিতিটাও নানা কারণে লেবারের অনুকূলে ছিল না। শুরু থেকেই লেবার পার্টির নেতৃত্বের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয় দুই ভাইয়ের প্রতিযোগিতায়। বড় ভাই ডেভিড মিলিব্যান্ড আদর্শিক দিক দিয়ে ছিলেন ব্লেয়ারের মানসপুত্র অর্থাৎ মধ্যপন্থী সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা অনুসরণের পক্ষে। বিপরীতে এড মিলিব্যান্ড হলেন বামপন্থা আদর্শিক ধারার অনুসারী এবং দলের নেতা হিসেবে তাঁর নির্বাচিত হওয়ার পেছনে অন্যতম বড় কারণ ছিল ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের ভূমিকা। ফলে শুরু থেকেই তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁকে হিসাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে এসেছে। আর রক্ষণশীল পত্রিকাগুলো বিশেষত, ডেইলি মেইল তাঁর পরাজয়ের পরও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে শিরোনামে বলেছে ‘ব্রিটেন রেড এডকে প্রত্যাখ্যান করেছে’।
এড মিলিব্যান্ড দলের নেতা হিসেবে রাজনীতিতে প্রথম যে লড়াইটা শুরু করেছিলেন, সেটা ছিল গণমাধ্যমের সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি পরিবার রুপার্ট মারডকের নিউজ করপোরেশনের দাপটের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ গণমাধ্যমে বিবিসিকে বাদ দিলে মারডক পরিবারের প্রতিপত্তি প্রায় একচেটিয়া। তখন একাধারে দুটো সর্বাধিক প্রচারিতসহ তিনটি দৈনিক—নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড সান এবং টাইমস-এর পাশাপাশি স্কাই টেলিভিশনের মালিকানার সুবাদে মারডকের দাপট কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছেছিল। প্রতি নির্বাচনের পর মারডকের সান তাই বিজয়ের কৃতিত্ব দাবি করে তার শিরোনামে দাবি করত যে ‘সান উওন ইট’ (সান এটি জিতেছে)। ক্যামেরনের সাবেক প্রচারসচিব অ্যান্ডি কুলসন ছিলেন এই মারডকের পত্রিকার কর্তা। আবার, সান-এর প্রধান রেবেকার সঙ্গেও ছিল ক্যামেরনের বন্ধুত্ব। মারডক পরিবারের প্রভাব তাই পুরো সরকারের ওপরই বিস্তৃত ছিল। মিলিব্যান্ড শুরুতেই সেটি ভেঙে দিতে সক্ষম হন। তবে এ জন্য এই নির্বাচনে তাঁকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হলো। গার্ডিয়ান, ইনডিপেনডেন্ট ও মিরর ছাড়া বাকি সব পত্রিকাই তাঁর প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে।
লেবার পার্টির জন্য আরও নিষ্ঠুর পরিহাসের বিষয় হলো স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ডের রাজনীতিতে লেবার দীর্ঘদিন ধরেই প্রধান দল হিসেবে আধিপত্য বজায় রেখেছে, যেখানে কনজারভেটিভরা কখনোই হালে পানি পায়নি। স্বাধীনতার প্রশ্নে স্কটল্যান্ডের যে গণভোট, তাতে লেবারের নেতৃত্ব এবং প্রচারণার সাফল্যেই দেশটির অখণ্ডতা রক্ষা পায়। অথচ, সেই স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামীদের হাতে জিম্মি হওয়ার আশঙ্কায় ইংল্যান্ডের ভোটাররা লেবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। রাজনীতির এই নিষ্ঠুর সমীকরণের পাশাপাশি অর্থনীতির হিসাবেও ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাসের শিকার হয়েছে লেবার পার্টি। স্কটল্যান্ডের ভোটাররা স্কটিশ জাতীয়তাবাদী দল—এসএনপিকে যে ভোট দিয়েছে তার প্রধান কারণ হলো মি ক্যামেরনের কৃচ্ছ্রের নীতি থেকে মুক্তি পাওয়া। অথচ, ওই কৃচ্ছ্রের অবসান ঘটানোর স্লোগান দিয়েও লেবার স্কটিশ ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হলো। ইংল্যান্ডের যেসব অঞ্চলে নিম্ন আয়ের কর্মজীবীদের প্রাধান্য, সেই উত্তরাঞ্চলে লেবার তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত সম্পদশালী কিংবা শ্বেতাঙ্গ-মধ্যবিত্ত প্রধান এলাকায় লেবারের সাফল্য নেই। দক্ষিণে একমাত্র ব্যতিক্রম লন্ডন, যেখানে ভোটারদের একটি বড় অংশ অভিবাসী এবং কর্মজীবী। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, লেবার পার্টি নিজেদের স্কটল্যান্ডে যেমন যথেষ্ট বামপন্থী হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি, তেমনই ইংল্যান্ডের প্রাণকেন্দ্রে নিজেদের যথেষ্ট মধ্যপন্থী বা নমনীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
এই নির্বাচনে নিষ্ঠুর পরিণতির শিকার আরেকটি বড় দল হলো লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। কয়েক দশক ধরে জাতীয় ভিত্তিতে তৃতীয় দল—প্রতিবাদের কণ্ঠ হি​েসবে যার অবস্থান গড়ে উঠছিল সেই দলটির আসনসংখ্যা ৫৭ থেকে নেমে এসেছে ৮–এ। আর ভোটের সংখ্যায় তাদের অবস্থান চতুর্থ। অধিকাংশ বিশ্লেষকের ভাষায়, বিগত জোট সরকারের কৃচ্ছ্রের জন্য ভোটাররা তাদেরই দায়ী করেছেন। অথচ সেই একই ভোটাররা ওই সরকারের যতটুকু ইতিবাচক অর্জন, সেগুলোর জন্য পুরস্কৃত করলেন কনজারভেটিভদের। রাজনীতি আসলে বড়ই নিষ্ঠুর। একইভাবে ভোটের সংখ্যা বিচারে তৃতীয় হওয়ার কথা যে দলটির, সেই ইউনাইটেড কিংডম ইনডিপেনডেন্টস পার্টি (ইউজিপ) তারা আসন পেয়েছে মাত্র একটি। এই দলটির অভিবাসন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী রাজনীতির সম্ভাব্য উত্থানের আশঙ্কায় বছর খানেক ধরে কনজারভেটিভ পার্টিতে চলছিল একধরনের অস্থিরতা। মাত্র কয়েক মাস আগে কনজারভেটিভদের দুজন এমপি দলত্যাগ করে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে ইউরোপের জন্য আসন করে দেন। ফলে কনজারভেটিভ দলের ভেতরে ইংলিশ জাতীয়তাবাদী তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিরোধীরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং মি ক্যামেরন ২০১৭ সালের মধ্যে একটি গণভোটের অঙ্গীকার করেন। গণভোটের বিষয় হবে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা অথবা না থাকা প্রশ্নে।
প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার জন্য ইইউর কাছে ছেড়ে দেওয়া রাজনৈতিক ক্ষমতাগুলোর অনেকটাই ফিরিয়ে আনতে চান। তিনি ইউরোপীয়দের অবাধে ইংল্যান্ডে অবাধে প্রবেশাধিকারের বিষয়েও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপের পক্ষে। কিন্তু ইউরোপ শুধু ইংলিশদের জন্য আলাদা কোনো সুবিধা দিতে রাজি নয়। ফলে, ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়বে বলেই সবার ধারণা। এমনিতেই আর্থিক সামর্থ্যহীনতার কারণে ব্রিটেনের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব দিন দিন কমছে। তারপর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলে বৈশ্বিক পরিসরে তার প্রভাব আরও কমতে বাধ্য। বিশ্বরাজনীতিতে কথিত মুক্ত বিশ্বের নেতা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও এ বিষয়ে ইতিমধ্যে খোলাসা করে বলেছেন যে ব্রিটেন ইউরোপের মধ্যে থাকলে তাঁরা যতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন, ইউনিয়নের বাইরে তা ততটা সম্ভব হবে না।
পাশাপাশি, নির্বাচনী প্রচারণায় স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁর যে বৈরী আচরণ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে করে উদ্বেগ বাড়ছে যে শেষ পর্যন্ত হয়তো স্কটল্যান্ডকে আর যুক্তরাজ্যে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। স্বভাবতই প্রশ্নে উঠেছে, মি ক্যামেরনের ক্ষমতা নবায়নের মূল্যটা হয়তো একটু বেশিই হয়ে যেতে পারে।
লন্ডন থেকে
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.