ধরন পাল্টাচ্ছে খুনের

পারিবারিক, রাজনৈতিক ও বক্তিগতসহ ছোটখাটো দ্বন্দ্বের জেরে খুনের ঘটনা বেড়েই চলছে। পাল্টাছে খুনের ধরনও। সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ১৪টি খুনের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। একদিকে নিজের জন্মদাতা পিতার হাতে খুন হয়েছে অবুঝ তিন সন্তান। আবার বাসায় ঢুকে মা-মেয়েকে একসঙ্গে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া, অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই ঘটছে এসব খুনের ঘটনা। অনেক খুনের ঘটনায় ভিকটিমের পরিবার বিচার না পাওয়ায় প্রায় একই কায়দায় খুনের ঘটনা ঘটছে। সমাজে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হত্যা মামলার বাদী বাবাকেও হত্যা করেছে একদল দুর্বৃত্ত। হত্যা মামলায় আদালত থেকে জামিন নিয়ে তারা নৃশংস এই ঘটনা ঘটায়।
সমাজ বিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, দিনে দিনে পাল্টাচ্ছে খুনের ধরনও। খুনের পর চোখ তুলে নেয়া, হাত পায়ের রগ কেটে দেয়া, শরীরের বিভিন্নস্থানে এসিড মেরে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়াসহ নানা কায়দা অবলম্বন করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হচ্ছে। এমনকি হত্যার পর লাশ কয়েক টুকরা করে গুম করার চেষ্টাও চলছে। সাম্প্রতি সময়ে একাধিক ঘটনায় ট্রাভেল ব্যাগের ভেতর থেকে নারী ও শিশুর লাশও উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ব্যাগে লাশ নিয়ে ভ্রমণ করতেও কুণ্ঠা বোধ করছে না দুর্বৃত্তরা। দিন দিন মানুষ আরও বেশি পাশবিক হয়ে উঠছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন মানসিকতা হলো ক্রমাগত মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফল। মানুষের মনের ভেতর থেকে মনুষ্যত্ব বোধ উবে যাচ্ছে। এ কারণে হত্যার পর লাশ নিয়ে ঘুরতেও মনের ভেতর কোনও সংশয় সৃষ্টি হয় না। আগে এমনটি দেখা যেতো কম।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, সমাজে অস্থিরতার বিরাজ করলে অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। এজন্য সমাজে যত অস্থিরতা কম থাকবে ততই অপরাধ কর্মকাণ্ড কম ঘটবে। একই সঙ্গে আইন ও বিচার ব্যবস্থা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে খুনের মতো পরাধ কওে কেউ আইনের ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে যেতে না পারে। অর্থাৎ অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে অপরাধ এমনিতেই কমে আসবে।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। খুন করে কেউ পার পেয়ে গেলে তা অন্যের কাছে দৃষ্টান্ত হয়। একজনকে দেখে অন্যরা উৎসাহিত হয়। এজন্য অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করাটা জরুরি। এছাড়া বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতাও অপরাধ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা একপর্যায়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসী বা দুর্বৃত্তরা রেহাই পেয়ে যায়। এছাড়া রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কেউ যেন পার না পায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া উচিত। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক কারণে নৃশংস খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই এসব ঠেকানো সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক সচেতনতা ও পারিবারিক শৃঙ্খল একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। প্রকৃত মানুষেরা ভেতরের পশুবৃত্তিকে চাপা দিয়ে রাখতে পারে। এতে স্বাভাবিকভাবেই সমাজে অপরাধের সংখ্যা কমে আসে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত চারমাসে সারা দেশে প্রায় ১ হাজার ৩০২ জন খুন হয়েছে। তবে ওই চারমাসের চাইতে মে মাসের খুনের সংখ্যা বেশি। এই হিসেবে প্রতি  মাসে গড়ে তিন শতাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। চলতি মাসে খুনের ঘটনা ঘটেছে আরও বেশি।
সূত্র জানায়, গত ১৫ মে ভোর রাতে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নে স্ত্রীর প্রতি অভিমান করে আবদুল গনি নামে এক ব্যক্তি তার তিন কন্যা জবাই করে হত্যা করেন। লোমহর্ষক ওই ঘটনায় এলাকায় শোখের ছায়া নেমে আসে। আবদুল গনি কয়েকদিন ধরে তার পাশের এক আত্মীয়র সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এতে তার স্ত্রী ফাতেমা ইউনিয়ন পরিষদের একটি ইউপি সদস্যসের কাছে নালিশ করলে রাগে ও ক্ষোভে তিনি তার তিন কন্যা সন্তানকে হত্যা করেন। এ আর আগে ১৪ মে রাতে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় উপজেলার মর্নেয়া ইউনিয়নের তালপট্টির নরশিয়ং গ্রামে শাহীনা খাতুন নামে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে দৃর্বৃতরা। একই দিন দুপুরে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার মির্জারপুল এলাকার ইক্যুইটি ভিলেজে খুন হন শারমিন আক্তার। এছাড়া পরাজধানীর পল্লবী এলাকায় জমি সংক্রান্তের বিরোধের জেরে আবদুর রহমান চঞ্চল নামে এক কলেজ ছাত্র খুন হয়েছেন। ১৩ই মে দুপুরে পল্লবীর ২০ নম্বর রোডে ৯ নম্বর সাততলা বাড়ির ছয়তলা ফ্ল্যাটে ঢুকে মামা ও ভাগ্নিকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহতরা হলেন, আমিনুল ইসলাম ও সুইটি খাতুন। চাঁদাবাজি ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে পরিবার ও পুলিশের ধারণা করছেন। ১২ মে দুপুরে সিলেটের বনকলাপাড়া নূরানী দিঘি এলাকায় প্রকাশ্যে দিবালোকে অনন্ত বিজয় দাস নামে এক ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই হত্যার দায় স্বীকার করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে এক জঙ্গি সংগঠন দায় স্বীকার করেছে। ১১ই মে নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৯ই মে রাতে রংপুরের কাউনিয়ায় মিরবাগের সাধু লিচুবাগান এলাকায় নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ীকে হাত-পায়ের রগ কেটে কুপিয়ে হত্যা করে সস্ত্রাসীরা। গত ৮ই মে রাতে চট্টগ্রামে শহরের মুরাদপুরের আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী ইব্রাহিমকে গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ৭ই মে সকালে চট্টগ্রামের নগরীর সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকার মোবাশ্বের হোসেনের ৬ তলা ভবনের চতুর্থ তলায় মা ও মেয়েকে পৈশাচিক কায়দায় খুন করে ৪ সন্ত্রাসী। নিহত মায়ের নাম নাসিমা আক্তার। আর মেয়ের নাম রিয়া আক্তার। ডাকাতির কারণে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছি বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
গত ৩রা মে দক্ষিণ বাড্ডায় জাগরণী ক্লাবের ভেতরে ঢুকে থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন রায়হানকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পশুর হাটের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ওই খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন। একই দিন সকালে কদমতলীর বউবাজার এলাকায় দুর্বৃত্তরা মানিক হোসেন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এর আগে গত ২০শে এপ্রিল রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে ডাকাতের গুলি ও ছুরিকাঘাতে মারা যান ৮ ব্যক্তি।

No comments

Powered by Blogger.