অভিবাসী তাড়াতে যুদ্ধজাহাজ বিমান মোতায়েন ইন্দোনেশিয়ার

আন্দামান উপকূলে এখনও ভাসছে হাজার হাজার অভিবাসীভর্তি নৌযান। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। তাদের উদ্ধারের জন্য জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আহ্বান থোড়াই কেয়ার করছে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। উল্টো অভিবাসীবোঝাই বোটগুলোকে তাদের সমুদ্রসীমা থেকে তাড়িয়ে দিতে তিনটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি বিমান পাঠিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। এ নিয়ে ওই সমুদ্রসীমায় ইন্দোনেশিয়ার মোট ৪টি যুদ্ধজাহাজ প্রহরায় নিয়োজিত হলো। একই সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া নিজ দেশের জেলেদের নির্দেশ দিয়েছে, তারা যেন সাগরে ভাসতে থাকা নৌযান থেকে আরোহীদের উদ্ধার না করে। ওইসব নৌকা বা নৌযান ডুবতে থাকলেও তাদের উদ্ধার না করতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে গতকালও মিয়ানমার উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৭ বাংলাদেশীকে। অভিবাসীতে ঠাঁসা একটি মাছধরা জেলে নৌকা মালয়েশিয়ার দিকে যাওয়ার পথে তাদের পানিতে ফেলে যায়। কেন তাদেরকে ফেলে যাওয়া হলো তা স্পষ্ট নয়। তবে একটি বোটে খাদ্য নিয়ে বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মধ্যে মারামারিতে যে ১০০ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার রিপোর্টে খবর দেয়া হয়েছে, এটিও হতে পারে সেরকম। ইন্দোনেশিয়ার আচেহতে পৌঁছা বাংলাদেশী মোহাম্মদ রফিক একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, যাত্রাপথের লোমহর্ষক সব ঘটনার কথা। তিনি বলেছেন, খাবার নিয়ে তাদের নৌকাতেই মারামারি হয়েছিল। এতে অন্তত ১০০ মানুষ নিহত হয়। তাদের কাউকে কাউকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে। কাউকে গলায় রশি পেচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কাউকে কাউকে নৌকা থেকে সাগরে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এমন অবস্থায় ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সুসিলো বামবাং ইয়োধোয়োনোর ডেমক্রেটিক পার্টির (পিডি) এমপি রুহুত মিতোমপুল মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী বোটবোঝাই অভিবাসীদের মানবিক সহায়তা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার কথায়, আচেহ ও উত্তর সুমাত্রার মধ্যে এখনও অনেক মানুষ আটকা পড়ে আছে। এসব মানুষের দিকে আরও সুনজর দেয়া উচিত ইন্দোনেশিয়ার। থাইল্যান্ড থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জোনাথন হেড জানান, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী ভর্তি আরও নৌকা ইন্দোনেশিয়ার দিকে যাচ্ছে। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের জেলেরা বলেছে, তারা কমপক্ষে দুটি নৌকা ইন্দোনেশিয়ার উপকূলের দিকে যেতে দেখেছে। গতকাল বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, অভিবাসী বোঝাই নৌযানকে তাড়িয়ে দিতে ইন্দোনেশিয়া তিনটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি বিমান মোতায়েন করেছে। এ সপ্তাহান্তে একটি নৌযান ইন্দোনেশিয়া ভেড়ার চেষ্টা করলে সে দেশের নৌবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করে। ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ফুয়াদ বাসিয়া বলেন, বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে অভিবাসীবাহী নৌযানকে ঠেকাতে মোট চারটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি বিমান টহল দিচ্ছে। মালয়েশিয়া থেকে মালাকা প্রণালী দিয়ে একটি নৌযান এগিয়ে যেতে থাকলে রোববার তাদের থামিয়ে দেয় তারা। ওই বোটের সঙ্গে রেডিও যোগাযোগের পর বোটটি ইন্দোনেশিয়ার দিকে ফেরত পাঠানো হয়। গতকাল মিয়ানমার যে ৭ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করেছে সে বিষয়ে কোস্ট গার্ড স্টেশন কমান্ডার ডিকসন চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারের মাছধরা নৌকা দিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করা হয় ওই বাংলাদেশীকে। এরপর তাদের বাংলাদেশের জেলেদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তারাই কোস্টগার্ডদের খবর দিয়েছেন বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাভর্তি তিনটি বোট সম্পর্কে। ওদিকে বিবিসির সংবাদদাতারা জানান, সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অভিবাসীদের গোপন শিবির, গণকবর এবং বহু মৃতদেহ পাওয়ার পর এ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তার পর থেকে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া এই অভিবাসীদের বহনকারী নৌকাগুলো তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না। তবে কয়েকশ’ লোক ইন্দোনেশিয়ার আচেহতে শিবিরে আশ্রয় পেয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষ নিজ দেশের জেলেদের বলে দিয়েছে যেন শুধু কোন নৌকা ডুবে যেতে থাকলে বা লোকজন সাগরে পড়ে গেলেই তাদের সাহায্য করা হয়।
আচেহর শিবিরে উদ্ধার করা অভিবাসীরা: জাতিসংঘ এর আগে খাবার ও পানির অভাবের মধ্যে থাকা এসব অভিবাসীকে তীরে ভিড়তে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু এখন জাতিসংঘ বলছে, কোন দেশই তা মানছে না। জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র ভিনসেন্ট ট্যান বলেছেন, ইন্দোনেশিয়ায় শুক্রবার কয়েকশ’ লোক অবতরণ করার পর থেকে আর কোন অভিবাসীই পাড়ে নামতে পারেনি। মিস ট্যান বলেন, সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। সংবাদদাতা ও অভিবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূল থেকে যাত্রা শুরুর পর খাদ্য ও পানির অভাবে, রোগে, পানিতে ডুবে বা অভিবাসীদের মধ্যে মারামারিতে কয়েক শ’ লোক নৌকার ওপরই মারা গেছে। ওদিকে থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিবিসির সাংবাদিক জনাথন হেড বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূলে ভাসমান এসব বোটে আটকে পড়া মানুষের বিষয়টি কোন সরকারই আন্তরিকভাবে নিচ্ছে না। মালয়েশিয়ায় প্রবেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সমুদ্র সীমান্ত ব্লক করে দিয়েছে। থাইল্যান্ডের কাছে যেসব নৌযান আটকা পড়ছে তারা দ্রুত তার ইঞ্জিন মেরামত করে ঠেলে দিচ্ছে গভীর সমুদ্রে। যদিও ওইসব নৌযানে রয়েছে অনাহারে ও অসুস্থতায় মৃত্যুমুখে অনেক মানুষ। আবার ইন্দোনেশিয়াও অভিবাসীদের দূরে ঠেলে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। এ জন্য তারা মিয়ানমারকে দূষছে। কিন্তু মিয়ানমার তার দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কিন্তু এখন যা প্রয়োজন তা হলো এসব অভিবাসী কারা, এর জন্য দায়ী কে সে চিন্তা না করে তাদের জীবন রক্ষা করা। এ অবস্থায় জাতিসংঘ সতর্কতা উচ্চারণ করেছে। তারা বলেছে, যদি কোন দেশ এসব মানুষকে গ্রহণ না করে তাহলে তারা মারা যাবে।
অভিবাসী সংকট নিরসনে মালয়েশিয়া ও থাই প্রধানমন্ত্রীকে বান কি-মুনের ফোন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী সংকট নিরসনে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন। ফোনালাপে এ অঞ্চলে উদ্ভূত অভিবাসী সংকট ইস্যুতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। মহাসচিব বলেন, অভিবাসী সংকট নিরসনে সব ধরনের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত জাতিসংঘ। এদিকে মুনের সহকারী জান এলিয়াসন বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মন্ত্রীদের সঙ্গে সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। এক বিবৃতিতে বান কি-মুনের মুখপাত্র বলেছেন, এ অঞ্চলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় তারা (মহাসচিব ও তার সহকারী) অভিবাসীদের প্রাণ রক্ষায় ও আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এ সময় দেশগুলোর নেতাদের সমুদ্রে উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনার বাধ্যবাধকতা ও অভিবাসীদের না ফেরানোর বিষয়ে অনুরোধ করেন তারা। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড অমানবিকভাবে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অভিবাসী ও দরিদ্র বাংলাদেশীবোঝাই বোটসমূহকে তীরে ভিড়তে না দিয়ে ব্যাপক সমালোচনা উস্‌কে দেয়। এদিকে অভিবাসী সংকট নিরসনের প্রচেষ্টায় থাইল্যান্ডের আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনায় আশ্বস্ত হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন মহাসচিব এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের নেতাদের এ সম্মেলনে অংশ নেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। বান কি-মুন বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তাবিত সম্মেলনসহ (থাইল্যান্ডের প্রস্তাবিত) জাতিসংঘ সব ধরনের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। গতকাল দক্ষিণ কোরিয়া সফর করার কথা জাতিসংঘ মহাসচিবের এবং এরপর যাওয়ার কথা ভিয়েতনাম সফরে।

No comments

Powered by Blogger.