লোডশেডিং বিড়ম্বনা by এস এ সোহেল

রূপগঞ্জে চলছে ভয়াবহ লোডশেডিং। প্রায় প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকছে রূপগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চল। অন্যদিকে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে গিয়ে বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তা ও দালালদের হয়রানির শিকার হচ্ছে জনগণ। রূপগঞ্জের ৩টি পল্লী বিদ্যুতের উপ-ব্যবস্থাপকের কার্যালয় ঘুরে দেখা গেছে দালালের দৌরাত্ম্য। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে নষ্ট হচ্ছে শিল্পকারখানার মেশিনারিজ, সাধারণ গ্রাহকদের টিভি ফ্রিজ। মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া। আর লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানার উৎপাদন। অনেক কারখানায় ঘণ্টায় ঘন্টায় জেনারেটর চালাতে গিয়েও পেরেশানির শিকার হচ্ছে শ্রমিক-কর্মচারীরা। ফলে দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনে ধস নেমে এসেছে। গত ১ মাস প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে দশ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকেছে রূপগঞ্জ। একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান এসব ব্যাপারে বিদ্যুৎ অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম, জাতীয় গ্রিডে লোডশেডিং, বিভিন্ন লাইনে মেরামত কাজ হচ্ছে এসব অজুহাত দিয়ে তারা তাদের দায় সারেন। লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে প্রতিদিনই কারখানার বিভিন্ন মেশিনের পার্টস, পাওয়ার বোর্ড, মটরসহ নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান মালামাল। পূর্ব কোন ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করে লোডশেডিংয়ের কারণে যন্ত্রাংশগুলো নষ্ট হচ্ছে। চলন্ত অবস্থায় এসব মেশিন নষ্ট হওয়ার কারণে উৎপাদন অবস্থায় নিয়ে যেতে খরচ হচ্ছে বাড়তি অর্থ। বড় বড় কয়েকটি কারখানায় গ্যাস জেনারেটর থাকলেও গ্যাসের সংকটের দোহাই দিয়ে নতুন গ্যাসের সংযোগ না দেয়ার রূপগঞ্জের প্রায় শতাধিক মিলকারখানায় ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালাতে হচ্ছে। ফলে গুণতে হচ্ছে লোকসান। এভাবে চলতে থাকলে অনেকেই দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা করছেন। পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকেই পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সঞ্চালন লাইনগুলোয় পালা করে লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে স্থানীয়দের জানিয়ে দেয়া হয় জাতীয় গ্রিড থেকে তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। যেটুকু বিদ্যুৎ তারা পাচ্ছেন তার পুরোটাই বিলি-বণ্টন করে দিচ্ছেন রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। ফলে লোডশেডিংয়ের কারণে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা তাদের লেখাপড়া ঠিকমতো করতে পারছে না অন্যদিকে গ্রাহকদের বাড়িতে টিভি, ফ্রিজ, বৈদ্যুতিক মোটর, বৈদ্যুতিক পাখা ও বাল্ব নষ্ট হচ্ছে। গত ২১শে মার্চ মুড়াপাড়া বিদ্যুৎ অফিসের অভিযোগ কেন্দ্রে গেলে দেখা যায় প্রায় ১৫-২০ জন গ্রাহক লোডশেডিংয়ের কারণে তাদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। মুড়াপাড়ার মাছিমপুর এলাকার সিরাজুল ইসলাম বিদ্যুৎ অফিসের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একপর্যায়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হন। তিনি জানান, গত চার দিনে লোডশেডিংয়ে প্রথমে তার বাড়ির টেলিভিশন, পরে পানি তোলার সাবমারসিবল পাম্প জ্বলে গেছে। প্রত্যেক মাসেই নিয়মিত বিল দেয়ার পরেও এসবের ক্ষতি পূরণ কে দেবে- এ নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে যান তিনি। বিদ্যুৎ অফিসের লোকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অফিসের লোকজন সিরাজুলকে অফিসের বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে বললে রেগে যান তিনি। একই অভিযোগ করেন হাটাব এলাকার আবদুল হাই। একই অবস্থা রূপগঞ্জের প্রায় সব এলাকায়। একদিকে যেমন লোডশেডিং অন্যদিকে নতুন সংযোগ পেতে অনলাইনে আবেদন করেও মাসের পর মাস বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে নতুন সংযোগ পাচ্ছে না গ্রাহকরা। অনেক গ্রাহকই গত দেড় থেকে দুই বছর আগে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সকল নিয়ম কানুন মেনে নতুন সংযোগের জন্য আবেদন  করেও সংযোগ পায়নি। বিদ্যুৎ অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের নিয়োগকৃত দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ না করার কারণে এ অবস্থা হয়েছে তাদের। বারবার ওই সব আবেদনপত্রের ফটোকপি অথবা মূল কাগজ নিয়ে ডিজিএম, এজিএমসহ বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছে যাওয়া হয়। এ সময় তারা দেখছি বলে এড়িয়ে যান। এমন একজন ভুক্তভোগী মাওলানা দ্বীন ইসলাম। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নারায়ণগঞ্জ এক এর সাওঘাট ডিজিএম অফিসে গত ২০১৩ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর ভুলতার মাঝিপাড়া এলাকায় তার নতুন বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য একটি আবেদন করেন। বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তাদের নির্দেশ মোতাবেক লাইনম্যান ও তাদের নিয়োগকৃত ব্যক্তি দিয়ে আনুষঙ্গিক সব কাজ সম্পূর্ণ করে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার আশায় প্রায় তিন বছর যাবত ঘুরছেন তিনি। তিনি জানান বিভিন্ন বিষয়ে দোষত্রুটি ধরে গত তিন বছর যাবত তার সংযোগটি সম্পন্ন করেনি বিদ্যুৎ অফিস। সংযোগ পাওয়ার জন্য একাধিক দালালের মাধ্যমে অফিসের কর্মকর্তাদের নগদ ২০ হাজার টাকা দিয়েও তিনি বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছেন না। এর পর একাধিকবার ট্রান্সফরমার পরিবর্তন করা হলেও সর্বশেষ তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে বিদ্যু সংযোগের খুঁটি থেকে তার বাড়ির দূরত্ব ১০০ ফুটের বেশি। তিনি বলেন, তার বাড়ি থেকে আরও ১৫-২০ ফুট দূরেও গত এক বছরে নির্মাণ হওয়া প্রায় ১০টি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ তার বাড়িতে সংযোগ দেয়া নিয়ে তারা টালবাহান করছেন। এমন অভিযোগ রূপগঞ্জের তিনটি বিদ্যুৎ অফিসে আসা প্রায় কয়েক শতাধিক ব্যক্তির। যার অধিকাংশই সাওঘাট ডিজিএম অফিসে। রূপগঞ্জের পূর্বাঞ্চলের এ অফিসটির আওতাধীন ভুলতা, গোলাকান্দাইল, কাঞ্চন, ভোলাব, আড়াইহাজারের দুপ্তরা ইউনিয়ন। আর এখানেই প্রতিটি মিটারের সংযোগ নিতে দালালরা নিচ্ছেন ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর এসব টাকা নিচ্ছেন বিদ্যুৎ অফিসের একাধিক কর্মকর্তাদের নাম করে। প্রতিটি সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে পল্লী বিদ্যুতের নির্ধারিত আবেদন ফরমের জন্য ১০০ টাকা, নিরাপত্তা জামানত ৬০০ টাকা, সদস্য ফি ২০ টাকা ও ২ হাজার টাকা মিটার বোর্ড, রড নিয়োগকৃত ইলেকট্রিশিয়ানদের চার্জ বাবদ নেয়ার কথা থাকলেও প্রতিটি মিটার পেতে যে কোন লোককে দিতে হয় তিন গুণেরও বেশি টাকা। সাওঘাট ও রূপগঞ্জ পূর্বাঞ্চল উপ-ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য মিটারের আবেদন করার পর দালাল ছাড়া কোন সংযোগই পান না গ্রাহকরা। এছাড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির লাইনম্যান, মিটার রিডারম্যানসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নতুন সংযোগ লাগাতে গেলে দিতে হয় বাধ্যতামূলক সালামি। নতুন সংযোগ পাওয়ার জন্য জনগণ আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গেই পাশে উপস্থিত দালাল অথবা তাদের নিয়োগকৃত কর্মীরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত বিদ্যুৎপ্রাপ্তির জন্য আলাপ-আলোচনা করার পরামর্শ দেন। বাধ্য হয়েই নতুন সংযোগের জন্য আবেদন করা ব্যক্তিরা দালালদের শরণাপন্ন হন। তাদের চাহিদামতো টাকা দেয়ার পরও ঘুরতে হয় মাস থেকে বছর পর্যন্ত। রূপগঞ্জের তিনটি উপ-ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে যোগদানের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে অথবা মন্ত্রী-এমপিদের মাধ্যমে তদবির করিয়ে থাকেন। এসব অফিসে যোগদান করার পর বিদ্যুৎ অফিসের দালালদের সঙ্গে আঁতাত করে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। এছাড়া সাধারণ গ্রাহকদের পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্য সংযোগের ক্ষেত্রে দালালদের মাধ্যমে যোগাযোগ করে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। অনেক সময় বাণিজ্য ও শিল্প বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া দুঃসাধ্য এমন অজুহাতে আটক রাখছেন এসব সংযোগ।
এদিকে শিল্প প্রতিষ্ঠানে সংযোগের জন্য রূপগঞ্জ জোনাল অফিসে ৩০০ অধিক আবেদনপত্র জমা পরেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রূপগঞ্জের একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নির্ধারিত নিয়মনীতি মেনে ও তাদের নির্ধারিত ফি জমা দেয়ার পর মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে তাদের পিছনে। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানান তাদের প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও নতুন সমপ্রসারিত অংশে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ফলে বাধ্য হয়ে অর্থ দিয়ে নিতে হচ্ছে নতুন সংযোগ। এসব বিষয়ে রূপগঞ্জ পূর্বাঞ্চল উপ-ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের (সাওঘাট) ডিজিএম মনোয়ার হোসেন ফিরোজি জানান, নানা অভিযোগ বিভিন্ন লোকজনের কাছে শুনেছেন তিনি। সদ্য যোগদান করায় এখনও অনেক কিছু তার জানার বাইরে। এমন কোন ঘটনা ঘটে থাকলে এসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। বৈধ উপায়ে, সঠিকভাবে কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে সাধারণ গ্রাহকসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সংযোগের ব্যবস্থা করা হবে। যদি টেকনিক্যাল কোন অসুবিধা না থাকে তবে সংযোগ পেতে হয়রানির শিকার হওয়ার কোন কারণ নেই বলে তিনি জানান। আর এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে আসা একাধিক ব্যক্তি। তারা প্রকাশ্যে অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার অভিযোগ করেন।

No comments

Powered by Blogger.