মালয়েশিয়ায় ৩০ গণকবর

থাইল্যান্ডের পর এবার মালয়েশিয়াতেও মিলল ৩০টি গণকবর। পাওয়া গেল মানব পাচারকারীদের ১৭টি বন্দিশিবিরও। গণকবরের একটি থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১০০ মৃতদেহ। শত শত বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীর দেহাবশেষ এই গণকবরগুলোতে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবর রয়টার্স, বিবিসি, এনবিসি, আল-জাজিরা ও দ্য স্টারের।
মালয়েশিয়ায় এই গণকবরের সন্ধান পাওয়ার আগে ১ মে পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে পাওয়া যায় এ রকমই একটি গণকবর। মেলে পাচারকারীদের বন্দিশিবির। গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয় ৩৫ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গার দেহাবশেষ ও কঙ্কাল।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহাদ জাহিদ হামিদের বরাত দিয়ে গতকাল রোববার গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, মালয়েশিয়ার থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলীয় পারলিস প্রদেশের শহর ও গ্রাম এলাকায় ওই গণকবরগুলোর সন্ধান মিলেছে। এগুলো মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়া অভিবাসীদেরই কি না, তা কর্মকর্তারা পরীক্ষা করে দেখছেন। এ পর্যন্ত কতজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, তা নিয়ে মন্ত্রী কিছু বলেননি।
তবে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, এ বিষয়ে আজ সোমবার পুলিশের মহাপরিদর্শক তান সেরি খালিদ আবু বকর এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের ব্যাখ্যা তুলে ধরতে পারেন।
খবর অনুযায়ী, ওই গণকবরগুলোতে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানো শত শত বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গার মরদেহ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ার পত্রিকা ইউটুজান মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলেছে, পুলিশ গতকাল পর্যন্ত ৩০টি গণকবর খুঁজে পায়। একটি থেকে গত শুক্রবার উদ্ধার করা হয় প্রায় ১০০ জনের মরদেহ।
এ খবরের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ বলেন, ‘আমার ধারণা, এটা প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য। কার্যত এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।’ তিনি জানান, সীমান্তবর্তী কেলিয়ান ইনতান ও পাদাং বেসার শহর এবং কয়েকটি গ্রামে পাচারকারীদের ১৭টি বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। শিবিরগুলোর কাছাকাছি স্থান থেকেই আবিষ্কৃত হয় এই গণকবরগুলো।
মন্ত্রী বলেন, পাচারকারীরা অন্তত পাঁচ বছর ধরে এ শিবিরগুলো পরিচালনা করেছে। দ্য স্টার জানায়, গত সপ্তাহে পুলিশ এই শিবিরগুলোর সন্ধান পাওয়ার সময় পাচারকারীরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে পুলিশ কমান্ডো ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা গেছেন। সেখানে ঠিক কতটা কবর ও মরদেহ আছে তা স্পষ্ট নয়।
এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজনের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি, অবশ্যই এর সঙ্গে মালয়েশীয়রা জড়িত।’ এ গণকবর আবিষ্কারের সঙ্গে থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশে পাওয়া গণকবরের সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করছে মালয়েশিয়া পুলিশ।
গণকবর পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলের নিন্দা ও সমালোচনার মুখে থাইল্যান্ড এরই মধ্যে মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। বিবিসির এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই চক্রে জড়িয়ে পড়েছে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের মানুষও।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, থাইল্যান্ডের পাচারকারী চক্র অন্য পাচারকারীদের কাছ থেকে সমুদ্রপথে নৌকায় আসা অভিবাসন-প্রত্যাশীদের প্রথম কিনে নেয়। সেখান থেকে নিয়ে যায় থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে নিজেদের আস্তানা বা বন্দিশিবিরে। এখানে আটকে ও নির্যাতন করে স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করে মুক্তিপণ। তা দিতে না পারায় অনেকে বন্দিদশায় অনাহারে ও অসুস্থতায় মারা যান। তাঁদেরই ঠাঁই হয়েছে গণকবরে।
থাইল্যান্ডের পর মালয়েশিয়ায় গণকবরের সন্ধান মেলার মধ্যে দেশ দুটির পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধার করা হয়েছে তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীকে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরে নৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার অভিবাসন-প্রত্যাশী।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মিয়ানমারে দশকের পর দশক ধরে সরকারের নিষ্ঠুর নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানরা। গত কয়েক দশকে এই নিপীড়ন বেড়ে যাওয়ায় হাজারো রোহিঙ্গা অভিবাসী প্রায়ই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আর এই দলে যোগ দিচ্ছে অনেক বাংলাদেশিও।
৮০ শতাংশ বন্দিশিবির মালয়েশিয়ায়: থাইল্যান্ডের মতো মালয়েশিয়াতেও পাচারকারীদের বন্দিশিবিরের অস্তিত্ব থাকা এবং সংখ্যায় তা অনেক বেশি হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল এ মাসের শুরুতেই। তবে মালয়েশিয়া সে অভিযোগে পাত্তা দিচ্ছিল না।
থাইল্যান্ডে উদ্বাস্তুদের সহায়তায় নিয়োজিত সংগঠন ‘রোহিঙ্গা ক্লাবের’ সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল কালাম অভিযোগ করেছিলেন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সীমান্তে যেসব বন্দিশিবির রয়েছে, তার ৮০ শতাংশই মালয়েশিয়ায়। একেকটি বন্দিশিবিরে রয়েছে ৫০০ থেকে ১০০০ অভিবাসী।
অবশেষে মালয়েশিয়ায় গণকবর ও বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই অভিযোগই সঠিক বলে প্রমাণিত হলো। তবে সংখ্যার বেশির ভাগটাই মালয়েশিয়াতে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
ইন্দোনেশিয়ার উদ্ধার অভিযান: সাগরে নৌকায় আটকে পড়া বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের অনুসন্ধান ও উদ্ধারে অভিযান শুরু করেছে ইন্দোনেশিয়া। আর এর মধ্য দিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা এই মানুষগুলোর উদ্ধার ও আশ্রয়দানের ব্যাপারে ইন্দোনেশিয়া তার কঠোর অবস্থান থেকে সরে এল বলে মনে করা হচ্ছে।
অভিযান শুরুর খবর গতকাল নিশ্চিত করেন দেশটির সেনা মুখপাত্র ফুয়াদ বাসায়া। এর আগে প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত বুধবারই মালয়েশিয়া সরকারের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া নিজেদের মনোভাব পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.