সুন্দরবন দিয়ে তেল ট্যাংকার নয়- সিদ্ধান্তটি আত্মঘাতী

তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবি, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে
সুন্দরবনের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানকে আত্মঘাতী হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে। তা না হলে গত ডিসেম্বরে সুন্দরবনে তেলবাহী কার্গো ডুবে যাওয়ার মতো বিপর্যয়কর ঘটনার পর আবার একই রুটে তেল ট্যাংকার চলাচলের অনুমতি দেওয়া হতো না। বোঝা গেল, মুখে যা-ই বলুক, বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের কোনো সদিচ্ছাই নেই। তেলের কার্গো ডুবে যাওয়ার ফলে সে সময়ে যে মাত্রায় দূষণ হয়েছে, তা বনটির ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। ওই দুর্ঘটনায় সে সময়ে যে তেল সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়েছে, তার তিন ভাগের এক ভাগও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। এসব বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের যৌথ মূল্যায়নের ভিত্তিতে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে তেলবাহী ট্যাংকার চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সীমিত আকারে ও কিছু শর্ত মেনে সেই রুটে কিছু নৌ–চলাচলের কথা বলা হয়। এসব কিছু তো মানা হচ্ছেই না, এখন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সেখান দিয়ে তেলবাহী ট্যাংকার চলাচলের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সুন্দরবন যেহেতু ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, তাই এই বন সব সময়ই তাদের নজরদারির মধ্যে রয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এই বনের মধ্য দিয়ে নৌ–চলাচল ও এর পাশেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অনন্য এই বনের গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি করতে পারে। সরকার যদি এই বন রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারে, তবে তা বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা হারাতে পারে। আগামী জুনে ইউনেসকোর এক সম্মেলনের আগে এ ধরনের একটি পদক্ষেপ সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।
সরকার যদি বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা থেকে সুন্দরবনকে ‘বিপন্ন’ অবস্থায় নামিয়ে আনতে না চায়, তবে এ ধরনের আত্মঘাতী পদক্ষেপ থেকে সরে আসতে হবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে আমরা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
সুন্দরবন দিয়ে আবার তেল ট্যাংকার চলাচলের অনুমতি by ইফতেখার মাহমুদ ও সুমেল সারাফাত
আপডেট:  ২৩মে, ২০১৫
জাতিসংঘের উদ্বেগ আর পরিবেশবাদীদের উৎকণ্ঠা উপেক্ষা করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে আবারও তেলবাহী কার্গো চলাচলের অনুমতি দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ‘ওটি সাউদার্ন সেভেন’ নামে একটি তেলবাহী কার্গো ডুবে বনে সাড়ে তিন লাখ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সরকার ওই পথ দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে।
তেলবাহী কার্গোডুবির পর বন বিভাগের চেষ্টায় সুন্দরবন থেকে এক লাখ লিটার তেল অপসারণ করা হয়। বাকি আড়াই লাখ লিটার তেল থেকে যায়, যা বনের প্রতিবেশে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি করতে পারে বলে জাতিসংঘ, বন বিভাগ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়ে বলেছিল, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল করায় এবং রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে বনের বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। এই ক্ষতি বন্ধে সরকার পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে সুন্দরবন ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাবে। এ ক্ষেত্রে ইউনেসকো থেকে সুন্দরবন রক্ষায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়।
এ বিষয়ে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আবার তেল ট্যাংকার চলাচলের অনুমতি দেওয়া অন্যায়। সুন্দরবনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বনটি ধ্বংস হলে শত চেষ্টা করেও তা ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই বনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কিছু দুর্বৃত্তের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এরা নিজেদের স্বার্থে সুন্দরবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সরকারের নৈতিক দায় থেকে সুন্দরবন রক্ষায় সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
নতুন করে তেলবাহী কার্গো চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয় গত ৬ এপ্রিল। তবে এবারও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুমতি নেয়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই বনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কিছু দুর্বৃত্তের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে-সুলতানা কামাল, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় ,কমিটির আহ্বায়ক
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, নদী দিয়ে নৌযান চলাচলের অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের। তারা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন ও সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রীয় কাজে দেশের বাইরে আছেন। তাঁরা দেশে ফিরলে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল: ৫ মে ৬৭০ মেট্রিক টন এমওপি সার নিয়ে ‘জাবালে নূর’ কার্গো জাহাজ সুন্দরবনের মরাভোলায় আটকে ডুবে যায়। এ সময় সরেজমিনে সেখানে গিয়ে তেলবাহী কার্গো চলাচল করতে দেখা যায়। শ্যালা নদীতে গিয়েও একাধিক তেলবাহী কার্গো চলাচল করতে দেখা গেছে। এগুলো চলাচলের সময় কোস্টগার্ড ও বিআইডব্লিউটিএর কোনো তদারকিও চোখে পড়েনি। অথচ সরকার গত ১ মার্চ শুধু দিনের বেলা সরকারি সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে সীমিত পরিমাণে নৌযান চলাচলের অনুমতি দিয়েছিল।
শরণখোলা এলাকার নৌকার মাঝি রাসেল মুন্সীসহ কয়েকজন জেলে জানান, গত ২৪ এপ্রিল শ্যালা নদী দিয়ে আসা তেলবাহী একটি জাহাজ শরণখোলার ভোলা নদীর মুখ ঘুরতে গিয়ে অল্পের জন্য দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। এ সময় এখানে নোঙর করে থাকা আরও চারটি কার্গোর ওপর তেলবাহী কার্গোটি প্রায় উঠে পড়েছিল।
বেশ কয়েকজন জেলে জানান, প্রতিদিনই ৮ থেকে ১০টি তেলবাহী কার্গো শ্যালা নদী দিয়ে চলাচল করছে। মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, গত মাস থেকে প্রতিদিনই ওই পথ দিয়ে তেলবাহী কার্গো চলছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষকে কিছু জানানো হয়নি।
আবার তেলবাহী কার্গো চলাচলের অনুমতিপত্রে বলা হয়, ‘বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড ও পুলিশ বিভাগের তত্ত্বাবধানে এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি সাপেক্ষে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামের প্রধান স্থাপনা থেকে গোপালগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ খুলনার দৌলতপুর ডিপোতে জ্বালানি তেল সরবরাহব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখার জন্য সুন্দরবন চ্যানেল তথা চট্টগ্রাম-বরিশাল-হুলারহাট-বগি সন্ন্যাসী-জয়মনীরঘোল-মংলা ও দৌলতপুর রুট দিয়ে জ্বালানি তেল পরিবহন করার অনুমতি নির্দেশক্রমে দেওয়া হলো।’

No comments

Powered by Blogger.