মার্কেট দখল করে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি by নূর মোহাম্মদ

বিস্ময়কর হলেও ঘটনা সত্য। খোদ রাজধানীতে শপিং মলের বিভিন্ন অংশ দখল করে শিক্ষাকাজ পরিচালনা করছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। ধানমন্ডির সোবহানবাগে প্রিন্স প্লাজার একটি তলার আংশিক ভাড়া নিয়ে সেখানে কার্যক্রম শুরু করেছিল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এরপর আশ্রয় নেয়া হয় নানা কৌশলের। কখনও ভবনের অংশবিশেষ কেনা হয়, কখনওবা করা হয় দখল। আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই ৫ বছর ধরে কার্যক্রম চালাচ্ছে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি। এ নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালতে চারটি মামলা  করেছেন ভুক্তভোগীরা। তিনটি মামলায় চার্জ গঠন করা হয়েছে। একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
তিন বছরের ভাড়ার চুক্তিনামা করে প্রায় ৫ বছর ধরে ভবনের ষষ্ঠ তলা জবরদখল করে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এ ছাড়া চতুর্থ তলার ২১টি দোকানসহ ৫ হাজার বর্গফুটের বেশি জায়গা দখল করে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ দুই ফ্লোরের ভাড়া বাবদ প্রিন্স প্লাজা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ৪ কোটি ৪১ লাখেরও বেশি টাকা পাওনা। নানা অজুহাতে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ভবনের নিজস্ব গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা, বেইজমেন্ট, সেমি-বেইজমেন্ট দখল করে সেখানে ইনফরমেশন সেন্টার করা হয়েছে। বেসরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলদারিত্বের কারণে পথে বসার উপক্রম হয়েছে ৩ শতাধিক দোকান মালিকের।
সরজমিন দেখা যায়, গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে শুরু করে প্রতিটি তলায় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শ্রেণীকক্ষ, প্রশাসনিক কক্ষ, ইনফরমেশন সেন্টার, শিক্ষার্থীদের বিশ্রামকক্ষ বানানো হয়েছে। দোতলায় দুটি জুয়েলারি দোকান ছাড়া মার্কেটে আর কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। বাকি থাকা এ জুয়েলারি দোকানিরা এখন পজিশন বিক্রি করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। ষষ্ঠ তলার ‘মনে রেখ’ শাড়ির শোরুমের মালিক জুলফিকার আলী মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে একটি মামলা করেছেন ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। মামলা নং-১৩৫/২০১৪। মার্কেটের একজন জুয়েলারি দোকানি অভিযোগ করে বলেন, একসময়ের জাঁকজমকপূর্ণ এ শপিং মলটি এখন মৃতপ্রায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনায় এখানে ক্রেতা আসে না। বাধ্য হয়ে অনেক দোকানদার পজিশন বিক্রি করে চলে গেছেন। এখন মার্কেটের বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই, ভেতরে কোন দোকান আছে কিনা। একটি বাণিজ্যিক ভবনকে আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখেছি। তিনি বলেন, ভবনের সামনে ড্যাফোডিল টাওয়ারসহ নানা ব্যানার টানিয়ে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পুরো ভবনের মালিক না হয়ে এটি কিভাবে ড্যাফোডিল টাওয়ার হলো এ প্রশ্ন করেন তিনি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ স্পষ্ট বলা আছে, কোন বাণিজ্যিক বা শপিং মল, জনবহুল জায়গা, প্রধান রাস্তার পাশে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস স্থাপন করা যাবে না। অথচ ড্যাফোডিল প্রতিষ্ঠিত একটি বাণিজ্যিক শপিং মল দখল করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস স্থাপন করেছে। মার্কেট দখল করে বিশ্ববিদ্যালয় বানানো হয়েছে- এমন অভিযোগ করে ব্যবস্থা চেয়ে মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ২০১২ সালের ৫ই মে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং ২০শে মে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব বরাবর আবেদন করেন। এ বিষয়ে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক শামসুল আলম বলেন, শপিং মল দখল করে ক্যাম্পাস স্থাপন করলে এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পরিপন্থি।
প্রিন্স রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, একসময়ের ঐতিহ্যবাহী এ শপিং মলটি একজন লোকের কারণে আজ মৃতপ্রায়। তিনি বলেন, ২০১০ সালের ১লা অক্টোবর ভবনের ষষ্ঠ তলা ভাড়ার চুক্তি হয়। ড্যাফোডিলের তৎকালীন রেজিস্ট্রার ড. ফখরে হোসেন সই করা চুক্তিতে বলা হয়, এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০১৩ সালের ৩০শে নভেম্বর। চুক্তির পরই বুঝতে পারি তাকে ভাড়া দিয়ে ‘খাল কেটে কুমির আনার’ মতো অবস্থা শুরু হয়েছে। নিয়মিত ভাড়া প্রদান না করা এবং প্রিন্স রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকে অহেতুক হয়রানি করা তাদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়।
আতিক বলেন, এ অবস্থায় ২০১২ সালের ১লা ডিসেম্বর প্রিন্স কোম্পানির পক্ষ থেকে ড্যাফোডিলের চেয়ারম্যানকে নোটিশ প্রদান করি। সেখানে ষষ্ঠ তলার বকেয়া ভাড়া পরিশোধ ও চুক্তিপত্র নবায়ন ও ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করে নতুন চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু সবুর খান ওই নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি এবং চুক্তিপত্র নবায়ন করেননি। সে অনুযায়ী ২০১৩ সালে ৩০শে নভেম্বরের পর ওই চুক্তি বাতিল ও অকার্যকর হয়ে যায়। প্রিন্স প্লাজার ষষ্ঠ তলার ১১ হাজার ২০০ বর্গফুট ও চতুর্থ তলার ৫২৫৪.০৮ বর্গফুট স্পেসের মালিক প্রিন্স রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ড্যাফোডিলের কাছে বকেয়া ভাড়া বাবদ ৪ কোটি ৪১ লাখ ১৬ হাজার টাকা পাওনা হয়। এ পাওনা টাকা নিয়ে নানা টালবাহানা করেন তিনি। ইউসিবি ব্যাংকের চেক দেন। ব্যাংকে চেক নগদায়নের জন্য দিলে ডিজঅনার হয়। এরপর ২০১৪ সালে আগস্ট মাসে চূড়ান্তভাবে তাকে নোটিশ করা হলেও কোন উত্তর দেয়নি ড্যাফোডিল। বাধ্য হয়ে প্রিন্স রিয়েল এস্টেট (প্রা.) লিমিটেড কোম্পানির পক্ষে আমি ড্যাফোডিলের চেয়ারম্যান সবুর খানের বিরুদ্ধে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করি। মামলা নং-৬৮/১৪, ধারা: ৪০৩/৪০৬/৫০৬ চার্জ গঠন হয়। দ্বিতীয় মামলা নং-৮২৭৪/১৪, ধারা: এনআই অ্যাক্ট ১৩৮ চার্জ গঠন হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৩শে এপ্রিল একটি মামলা করেছি। মামলা নং-৫৯/১৫, ধারা: ৪১৭ দণ্ডবিধি। এ মামলার পর সবুর খানের বিরুদ্ধে ২৩শে এপ্রিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এর আগে ১৫ই এপ্রিল সবুর খান ষষ্ঠ তলার ফ্লোর ভেঙে ফেলে। সেখানে নতুন করে ডেকোরেশনের কাজ শুরু করেন। চুক্তির সময় আগের থাকা ডেকোরেশন যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা, সেই ডেকোরেশন সবুর খানের লোকজন সরিয়ে ফেলে। সেখানে তার মতো করে ডেকোরেশনের কাজ শুরু করেছে, যা সরজমিন গিয়েও দেখা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রিন্স রিয়েল এস্টেট (প্রা.) লিমিটেড কোম্পানি প্রিন্স প্লাজা বাণিজ্যিক ভবনের বেইজমেন্ট, সেমি-বেইজমেন্ট ও প্রথম তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত দলিল মূলে ৬০%, ষষ্ঠ তলা থেকে তদূর্ধ্বে ৬৪%, ষষ্ঠ তলার ল্যান্ডওনারের ৪০% অংশ ও নবম তলার ৩৬% অংশ দলিল মূলে ল্যান্ডওনারের কাছ ২০০৩ কিনে নেন। তখন থেকে এ ভবনের মালিক ছিল প্রিন্স রিয়েল এস্টেট। বর্তমানে প্রিন্স প্লাজা বাণিজ্যিক ভবনের ষষ্ঠ তলার সম্পূর্ণ ফ্লোর প্রায় ১১ হাজার ২০০ বর্গফুট, নবম তলার সম্পূর্ণ ফ্লোর প্রায় ১১ হাজার ৪৮০ বর্গফুট, নবম তলার ওপরে ৬৪% প্রায় ৭৩৪৭.২০ বর্গফুট, চতুর্থ তলার ৫২৫৪.০৮ বর্গফুট, বেইজমেন্ট ফ্লোরের ৬০%, সেমি-বেইজমেন্ট ফ্লোরের ৬০%-সহ প্রায় ৫টি ফ্লোরের দলিল মূলে বৈধ মালিকানায় আছে প্রিন্স রিয়েল এস্টেট (প্রা.) লিমিটেড কোম্পানি।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সবুর খান বলেন, অভিযোগ সত্য না। এ ভবনের ১৩৭ জন মালিক ছিলেন। কেউ আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। ষষ্ঠ তলার বিষয়ে তিনি বলেন, ওই ফ্লোর দেখিয়ে মালিকপক্ষ আতিকুর রহমান একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ওই ব্যাংক আমাকে তার সঙ্গে কোন লেনদেন করতে মানা করেছে। এখন আমি কাকে ভাড়া দেবো প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি বলেন, এ ভবনটি প্রায় পুরোটাই আমি কিনেছি। ষষ্ঠ তলার ‘মনে রেখ’ শাড়ি এবং দোতলার দুটি জুয়েলারি দোকানদার আমার কাছে বিক্রি করতে এসেছেন। আমি তাদের কাছ থেকে একটু সময় নিয়েছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এগুলো কিনে নেবো। একটি বাণিজ্যিক ভবন কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিল্ডিংয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদন দিয়েছেন। আতিকুর রহমান আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এখন আদালতেই বিষয়টি সুরাহা হবে।

No comments

Powered by Blogger.