চট্টগ্রামে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ by কাজী সুমন ও মহিউদ্দীন জুয়েল

সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তে উচ্ছ্বসিত চট্টগ্রামের সাধারণ ভোটাররা। এমনকি প্রার্থী, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। একইসঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ ৫৯১টি ভোটকেন্দ্রে নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলমের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আবার অনেক এলাকায় সরকারদলীয় প্রার্থীদের একের পর এক হুমকিতে তটস্থ বিরোধী দলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীরা। এসব ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে পুরো চট্টগ্রামে।  কিন্তু মঙ্গলবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটিতে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে। আন্দরকিল্লা সাবেরিয়া এলাকার পুস্তক ব্যবসায়ী শিপক নাথ বলেন, ২০১০ সালে এখানে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে এবার এলাকায় বেশ উত্তেজনা চলছে। আমাদের কেন্দ্র হচ্ছে ঘাটফরহাদবেগ স্কুল। গত কয়েকদিন ধরে দুই মেয়র প্রার্থীর লোকজনের মধ্যে এখানে যেসব কথাবার্তা চলছে তাতে আমরা শঙ্কিত। শুনেছি এলাকায় অনেকে নাকি অস্ত্রও ব্যবহার করছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে আন্দরকিল্লা, মোমিন রোড, রাজাপুকুর লেইন, রহমতগঞ্জ, দেওয়ানজী পুকুরপাড়, জামাল খান, বদরপাতিসহ অন্তত ২০টি কেন্দ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হলে ভাল হবে।  বায়েজীদ বোস্তামী এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ৬১টি ভোটকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি স্থানীয় লোকজনের। ওই এলাকায় ইতিমধ্যে মনজুর কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নাছিরের সমর্থকদের ব্যানার ছিনিয়ে নেয়া ও একে-অপরের ওপর হামলা চালানোর ঘটনা ঘটেছে। ওই এলাকার পলিটেকনিক ওয়ার্ডের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এবার নির্বাচনটা জমে উঠেছে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা সন্দেহ। কারণ ভোটের দিন ভোট দিতে যাবো কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। এখন সেনাবাহিনী যদি আমাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারে তাহলে অবশ্যই কেন্দ্রে যাবো। সেনাবাহিনী নামার এই সিদ্ধান্তে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন মেয়র প্রার্থীরাও। তবে সরকারদলীয় প্রার্থী আ জ ম নাছির অবশ্য বলেছেন, এই নিয়ে তিনি কোন কিছু আশঙ্কা করছেন না। কারণ নির্বাচন কমিশনের যে কোন সিদ্ধান্ত মেনে তিনি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে আ জ ম নাছির বলেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে কিনা সেই বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। তবে একজন প্রার্থী হিসেবে আমি নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে। এখানে পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনী আমার কাছে বড় নয়। তিনি আরও বলেন, আমি নির্বাচন কমিশনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। গত ১৫ দিন ধরে প্রচারণা চালিয়ে আমি এটুকু নিশ্চিত হয়েছি চট্টগ্রামের মানুষ পরিবর্তন চায়। তার নেতৃত্বে একজন উদ্যমী, দক্ষ ব্যক্তিকে নগরপিতা হিসেবে আশা করছেন। জনগণের সেবা করার জন্য আমি মাঠে নেমেছি। অন্যদিকে সেনাবাহিনী নামার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম ও জাতীয় পার্টির সোলায়মান আলম শেঠ। এ ব্যাপারে মনজুর আলম বলেন, সেনাবাহিনী নামিয়ে শুধু টহল দিলেই চলবে না। তাদের বিচারিক ক্ষমতা দিতে হবে। ভোটারদের মানসিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে। আমি আশা করবো, আইন অনুযায়ী  সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করবেন।  জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোলায়মান শেঠও একই রকম মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনের দিন যেসব এলাকায় হট্টগোল ও হাঙ্গামা তৈরি হতে পারে সেইসব জায়গায় নজরদারি বাড়াবে- এমনটা আশা করছি। বিশেষ করে ভোটের শেষ মুহূর্তে দুপুরের দিকে প্রভাবশালী প্রার্থীদের লোকজন কেন্দ্র দখলের পাঁয়তারা করছে বলে আমাদের কাছে খবর আসছে। এই খবর উদ্বেগজনক। চট্টগ্রাম বিএনপির শীর্ষ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমি মনে করি, কেবলমাত্র পুলিশ দিয়ে সরকারদলীয় ক্যাডারদের তাণ্ডব ঠেকানো সম্ভব নয়। বেশ কয়েক জায়গায় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে আমাদের মেয়র প্রার্থীদের প্রচারণায় হামলা হয়েছে। তাই সেনাবাহিনীকে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, সেনাবাহিনী নামার খবরে অনেক ভোটারের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে এক্ষেত্রে তারা কি ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন নাকি আলাদা ক্ষমতা নিয়ে কাজ করবে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমি মনে করি তাদেরকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য কাজ করার অবাধ সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের সম্মুখে একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকলেও থাকতে পারেন। সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি বিরাজ করছে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ যুবদলের সহ-সভাপতি শাহ্‌ সরোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, মামলা-হামলা ও সরকারের দমন-পীড়নের শিকার হয়ে ২০ দলীয় জোটের অনেক নেতাকর্মীই আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। তবে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তে তাদের সেই আতঙ্ক কেটে যাবে। নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে। চট্টগ্রামের সিনিয়র নেতাদের দলীয় কোন্দল মেটানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এখন ২০ দল সমর্থিত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান যেভাবে সব গ্রুপকে সমন্বয় করে মাঠে কাজ করছেন একই ভাবে অন্য সিনিয়র নেতাদেরও কাজ করতে হবে।  পশ্চিম বাকলিয়ার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. সাঈদ। ওই এলাকায় ছোট্ট টং দোকানে পান-সিগারেট বিক্রি করেন। নির্বাচনের পরিবেশের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, এই এলাকায় পরিবেশ মোটামুটি শান্ত। এখনও কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে ৫ই জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর ভোটকেন্দ্রে যেতে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে একটা অনীহা ভাব তৈরি হয়েছিল। সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তে একটা স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হবে। দুষ্কৃতকারীরা ভয়ভীতি দেখাতে পারবে না। আশা করছি সবাই স্বস্তি নিয়েই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে। নগরীর চকবাজার এলাকায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসায়ী করেন ফয়সাল। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তরুণ এই ব্যবসায়ী জানান, ভোটের দিন প্রভাবশালী প্রার্থীদের কেন্দ্র দখলের একটি পাঁয়তারা থাকে। এছাড়া বোমাবাজি করে আতঙ্ক তৈরি করতে পারে তারা। তবে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করলে তারা সেই সুযোগ পাবে না। সাধারণ ভোটাররাও নির্দ্বিধায় ভোটকেন্দ্রে যাবে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটকেন্দ্র রয়েছে ৭১৯টি। এর মধ্যে ৫৯১টি চিহ্নিত হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে। সবচেয়ে বেশি ঝুকিঁপূর্ণ ভোটকেন্দ্র রয়েছে কোতোয়ালি থানায়। ওই থানায় রয়েছে ৮৪টি ভোটকেন্দ্র। পাশাপাশি বায়েজীদ বোস্তামী এলাকায় আছে ৬১টি, আকবর শাহ্‌ থানায় ২৭টি,  বাকলিয়া থানায় ৩৮টি, সদরঘাটে ২৫টি, পাঁচলাইশে ২৬টি, খুলশীতে ২৯টি, চান্দগাঁওয়ে ৫৬টি, ডবলমুরিং ৫৫টি, হালিশহরে ৩৮টি, পাহাড়তলীতে ৩৪টি, বন্দরে ৩৩টি, ইপিজেড-এ ৩৬টি, পতেঙ্গার ২৫টি কেন্দ্রে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যদের টহল বাড়ানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শহরের বাইরে হাটহাজারী থানার ৪টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত হওয়ায় সেখানেও থাকবে একাধিক পুলিশ সদস্য। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দাবির মুখে চকবাজার এলাকার ২৪টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত করেছে পুলিশ প্রশাসন।

No comments

Powered by Blogger.