রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি- শ্রমিকরা এখনও অধিকার বঞ্চিত, সরকারের কাছে তিন সুপারিশ

জুরাইন কবরস্থানে সন্তানের ছবি জড়িয়ে কান্না
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দু’বছর পরও বাংলাদেশের শ্রমিকরা অধিকার বঞ্চিত। এ অবস্থায় শ্রম আইন কার্যকর ও শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতি দুর্ব্যবহারের ইতি টানতে হবে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দু’বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এমন আহ্বান জানায়। এতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তারা তিনটি সুপারিশ তুলে ধরেছে। সেগুলো হলো- ১. যেসব কারখানা মালিক শ্রমিক ইউনিয়ন বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করুন। শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন করার দায়ে তারা অভিযুক্ত হলে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে ও তাদের শাস্তি দিতে হবে। ২. সরকারকে বাড়াতে হবে শ্রমিক, অগ্নি ও ভবন সংক্রান্ত পরিদর্শক। তাদের দিতে হবে উন্নততর প্রশিক্ষণ। নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে। ৩. অভিযোগ দেয়ার মতো কার্যকর একটি মেকানিজম প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ভীতি ছাড়াই শ্রমিকরা তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার সংক্রান্ত অভিযোগ সেখানে তুলে ধরতে পারেন। শ্রম আইন আবার পর্যালোচনা করে নিশ্চিত হতে হবে যে, এটা আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকারের মানদণ্ড নিশ্চিত করে কিনা। এসব মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে মুক্তভাবে সমাবেশ সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশনের ৮৭ নম্বর ধারা। সংগঠিত হওয়া ও সমন্বিতভাবে দর কষাকষি করার অধিকার সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশনের ৯৮ নম্বর ধারা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গতকাল এ বিষয়ে ৭৮ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম “হু-এভার রেইজেস দিয়ার হেড, সাভারস দ্য মোস্ট: ওয়ার্কার্স রাইটস ইন বাংলাদেশজ গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিস”। এতে আরও বলেছে, বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকরা নাজুক কর্মপরিবেশে কাজ করছেন। নিয়োগকারীরা তাদের ওপর চালাচ্ছে শ্রমিক ইউনিয়ন বিরোধী কৌশল। দু’বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে কমপক্ষে ১১০০ শ্রমিক প্রাণ হারান। সে ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার ও পশ্চিমা ক্রেতারা যা করতে পারে এবং যা করা উচিত তা হলো এখানে শ্রমিকদের অধিকার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিশ্চিত করা। তাদেরকে ইউনিয়ন করার অধিকার দিতে হবে। উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিষয়ক উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, বাংলাদেশ যদি রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো আরেকটি দুর্ঘটনা এড়াতে চায়, তাহলে দেশটির উচিত কার্যকরভাবে শ্রম আইন বাস্তবায়ন করা। পোশাক কারখানার কর্মীরা যাতে পাল্টা-দুর্ব্যবহার ও চাকরিচ্যুতির আশঙ্কা ছাড়াই নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশের ব্যাপারে তাদের উদ্বেগের কথা প্রকাশের অধিকার পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, পোশাক প্রতিষ্ঠানের যে ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপকরা শ্রমিকদের ওপর হামলা এবং ইউনিয়ন গঠনের অধিকারকে অস্বীকার করেন, বাংলাদেশ যদি তাদের দায়ী না করে, সেক্ষেত্রে সরকার এ ধরনের প্রথাকে স্থায়ী করে তুলবে। এসব প্রথার কারণে হাজার হাজার পোশাক শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার, পোশাক প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং পশ্চিমা পোশাক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের প্রতি এইচআরডব্লিউ শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং পোশাক প্রতিষ্ঠানের মালিক ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের (সুপারভাইজার) শ্রমিক নেতাদের বেআইনিভাবে টার্গেট করার ঘটনাগুলো অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ক ৭৮ পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টটি প্রণয়ন করা হয়েছে ৪৪টি কারখানার ১৬০ জনেরও বেশি শ্রমিকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। এসব কারখানা উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রেতাদের জন্য পোশাক প্রস্তুত করে। এতে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা শারীরিক নির্যাতন, মৌখিক নির্যাতন, কখনও কখনও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তাদেরকে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয় না। সময়মতো পূর্ণাঙ্গ বেতন ও বোনাস দেয়া হয় না। সম্প্রতি বাংলাদেশের শ্রম আইনের সংস্কার করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও অনেক শ্রমিক, যারা শ্রমিক ইউনিয়ন করার চেষ্টা করেছেন তাদেরকে ওই ধরনের হুমকি, ভীতি প্রদর্শন করা হয়। চাকরিচ্যুতির হুমকি দেয়া হয়। কখনও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এক্ষেত্রে নির্যাতন চালায় কারখানার ম্যানেজমেন্ট অথবা ভাড়াটে তৃতীয় পক্ষ। বাংলাদেশ সরকার, কারখানা মালিক ও পশ্চিমা ক্রেতাদের প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আহ্বান জানিয়েছেন শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করতে। এতে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ণনা দেয়া হয়।  তারপরই বলা হয়, ওই ট্র্যাজেডির পর শ্রম আইনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। শ্রমিক ইউনিয়ন নিবন্ধন বিষয়ক বিধিবিধান সহজ করা হয়েছে। নতুন শ্রমিক ইউনিয়ন নিবন্ধিত করার সুবিধা দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানার শতকরা ১০ ভাগেরও কম আছে শ্রমিক ইউনিয়ন। শ্রমিক নেতারা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, কারখানার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন তারা। এক্ষেত্রে ম্যানেজার ও সুপারভাইজার দুজনেই তাদেরকে নির্যাতন করে। অথবা মালিক পক্ষের লোকজন এসব ঘটনা ঘটায়। কিছু কারখানায় শ্রমিকরা ইউনিয়ন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু  শ্রমিকদের সংগঠিত করার অপরাধে তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কারখানা মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। বিজিএমইএর এক কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ে আমাদের একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা বিশ্বাস করেন যে, তাদের কাজ করার প্রয়োজন নেই এবং তাতেই তাদের বেতন দিতে হবে। রিপোর্টে বলা হয়, শ্রমিকরা নিয়মিত দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হন। কারখানায় রয়েছে নাজুক পরিস্থিতি। রয়েছে শারীরিক ও মৌখিক নির্যাতন। গাজীপুরের একটি কারখানার এক শ্রমিক নেতা বলেন, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে তিনি ও অন্য কয়েকজনে মিলে ইউনিয়ন গঠন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদেরকে নারকীয় অবমাননার শিকার হতে হয়েছে। অনেক শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তিনি অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় তাকে প্রহার করা হয়েছে। রাতে কাজ করাতে বাধ্য করানো হয়েছে। এমনকি চাকরিচ্যুতি করা হয়েছে। কিন্তু তাকে বকেয়া ও পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। কারণ, তিনি শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করা বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ওই শ্রমিক বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে ধাতব রড দিয়ে আমাকে প্রহার করা হয়েছে। আমাকে ডেকে নেয়া হয় চেয়ারম্যানের রুমে। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় তৃতীয় তলায় ম্যানেজমেন্ট রুমে। সেখানে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা আমাকে প্রহার করে। ফিল রবার্টসন বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও বিদেশী ক্রেতাদের নিশ্চিত করতে হবে শ্রমিকদের অধিকার। তাদের সঙ্গে যারা দুর্ব্যবহার করে তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে সরকারের। শুধু কারখানার পরিবেশ নিরাপদ করাই যথেষ্ট নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশে যেসব ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে তা থেকে দেখা যায় যে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা না করার সঙ্গে এমন ভয়াবহ কর্ম পরিবেশ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই প্রথমেই শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য দায়ী বাংলাদেশ সরকার।

No comments

Powered by Blogger.