নৃশংস হত্যাকাণ্ডে নিহতদের পরিবারে কান্না by আল আমিন

‘নির্বাক মন নিয়ে বসে ছিলেন নুরুল আলম। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। মাঝে মাঝে তার ভাই ওয়ালীউল্লাহর মেয়েদের গলা ধরে আহাজারি করছেন। এভাবে মেধাবী ও কর্মঠ তার ভাই দুষ্কৃতকারীদের হাতে প্রাণ হারাবেন তারা কেউ ভাবতেই পারেননি। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, খুনিদের শাস্তি দিতে হবে। নিহতের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে গেলে এমন চিত্র দেখা মেলে। আশুলিয়ার ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় নিহত এক ডাকাতসহ ৮ জনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মঙ্গলবার গভীর রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে নিয়ে আসে পুলিশ। নিহতের আত্মীয়স্বজনেরা তাদের লাশ নেয়ার জন্য ওই মর্গ এলাকায় ভিড় করেন। তাদের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। অনেকেই মূর্ছা যান। ওই ঘটনায় নিহত চাল ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদের শরীরে দুই রাউন্ড গুলির চিহ্ন পেয়েছে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। বাকি ৭ জন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারা গেছেন বলে ময়নাতদন্তের সূত্রে জানা গেছে। গণপিটুনীতে নিহত অজ্ঞাত ডাকাত এর কোন পরিবারের সদস্যকে পাওয়া যায়নি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তার লাশ হাসপাতালের মর্গে আছে। বাকি ৭ জনের লাশ ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর নিজ নিজ পরিবারের মাঝে হস্তান্তর করেছে কর্তৃপক্ষ। নিহতরা হলেন, ব্যাংকের ম্যানেজার মো. ওয়ালীউল্লাহ (৪৫), জমির উদ্দীন (৩৫), গানম্যান কাজী বদরুল আলম (৪৫), মুড়ি বিক্রেতা মনির হোসেন (৫৫), অজ্ঞাত ডাকাত (৩০), প্রিন্টের ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দীন মোল্লা পলাশ (৫৫), চাল ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ (৫০), নিরাপত্তা রক্ষী ইব্রাহিম (৩৫)। নিহত ওই ব্যাংকের ম্যানেজার মো. ওয়ালীউল্লাহর ভাই নুরুল আলম জানান, গত ৫ বছর ধরে তার ছোট ভাই ওই ব্যাংকের ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ব্যাংকের পাশের এলাকায় একটি বাড়িতে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন। এর আগে তিনি জনতা ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। ডাকাতরা তার ভাইয়ের কাছে টাকা রাখার ভোল্টের চাবি চেয়েছিল। কিন্তু, ওয়ালীউল্লাহ তা দিতে রাজি হয়নি।
তিনি আরও জানান, ওয়ালীউল্লাহ নিহত হওয়ার পরেই তার স্ত্রী মোখলেসা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। নিহত জমির উদ্দীনের চাচাতো ভাই ইসমাঈল হোসেন জানান, আশুলিয়ার জহরচন্দ্রা এলাকার একটি টিনসেডের বাড়িতে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন ইসমাঈল। ওই এলাকায় তার টেইলার্সের দোকান আছে। তিনি বিবাহিত ছিলেন এবং দুই সন্তানের জনক। ইসমাঈল হোসেন আরও জানান, ওই ব্যাংকে ডাকাতেরা হানা করেছেন এমন সংবাদ পেয়ে তিনি সেখানে ছুটে যান। তিনি ডাকাতদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। এ সময় ডাকাতদের এলোপাতাড়ি গুলি ও ছুরির আঘাতে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। তার বুকে দুটি গুলির চিহ্ন আছে। তার মৃত্যুতে পরিবারের সদস্যরা দিশেহারা। গানম্যান কাজী বদরুল আলমের বড় ভাই কাজী একরামুল হক জানান, তার ভাই সেনাবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার ছিলেন। গত দুই বছর ধরে ওই ব্যাংকে গানম্যান ছিলেন। আশুলিয়ার খেঁজুরটেক এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তার তিন মেয়ে আছে। তিনি আরও জানান, ওই ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মুখে শুনেছি যে, ব্যাংকে যখন ডাকাতেরা ঢুকেছিল তখন তিনি প্রথম তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। পরে তারা তাকে এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়েছিল। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। নিহত মুড়ি বিক্রেতা মনির হোসেনের ছেলে আজিজুল হক জানান, তার পিতা আশুলিায়ার কাঠগড়া এলাকায় একটি টিনসেডের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকেন। ওই ব্যাংকে ডাকাতেরা হানা দেয়ার পরেই তিনি ঘটনাস্থলে যান। তিনি ওই ব্যাংকের গেট বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ডাকাতদের সঙ্গে তার ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে ডাকাতদলের সদস্যরা তাকে ছুরিকাঘাত করলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। ঘটনাস্থলে স্থানীয়দের গণপিটুনীতে নিহত ডাকাতের কোন  পরিবারের লোকজন গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেনি। তার পরনে ছিল চেক শার্ট ও সাদা জিন্স প্যান্ট। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার সারা শরীরে জখমের চিহ্ন আছে। ডাকাতি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়রা তাকে লাঠি ও রড দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। নিহত ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দীন মোল্লা পলাশের স্ত্রী নাজনীন আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তার স্বামী আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকায় প্রিন্টের ব্যবসা করতেন। তিনি ব্যাংকের গ্রাহক ছিলেন। ঘটনার দিন তিনি ওই ব্যাংকের টাকা জমা দিতে গিয়েছিলেন। তিনি আরও জানান, ডাকাতেরা ওই ব্যাংকে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এলোপাতাড়ি গুলি করে। আশপাশে যাকে পায় তাকেই চাপাতি দিয়ে কোপায়। ওই ডাকাতদের সামনে পড়েছিল তার স্বামী। ডাকাতদের এলোপাতাড়ি চাপাতির কোপে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাদের সংসারে কোন সন্তান  নেই। পলাশের পিতার নাম শামসুদ্দীন মোল্লা। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকূপার লক্ষিণদিয়া এলাকায়। ৫ ভাই ৪ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।  চাল ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদের ভাই বদিয়ার রহমান জানান, তার ভাই কাঠগড়া বাজার এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তিনি ১ ছেলে ও ৫ মেয়ের জনক। ওই এলাকায় তার একটি চালের দোকান আছে। তিনি আরও জানান, ওই ব্যাংকে ডাকাতেরা হানা দেয়ার সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি কয়েকজন ডাকাতকে ধরার চেষ্টা করেন। ওই সময় ডাকাতেরা তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। নিরাপত্তা রক্ষী ইব্রাহিমের চাচাতো ভাই ইউনুস আলী জানান, তার ভাই ওই ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তিনি ৩ সন্তানের জনক ছিলেন। তিনি আরও জানান, ডাকাতেরা ওই ব্যাংকে ঢোকা মাত্র ইব্রাহিম তাদের বাধা দেন। এ সময় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এতে তারা তাকে ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করলে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। ইব্রাহিমের পিতার নাম মোজাহার উদ্দীন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী জানান, শুধু একজন বাদে নিহত ৭ জন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.