দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাতি- বীভৎসতা থেকে রেহাই পায়নি কেউ by নুরুজ্জামান লাবু ও হাফিজ উদ্দিন

ভয়ঙ্কর, নির্মম, নৃশংস। ঘটনার ভয়াবহতা এমন যে এসব শব্দ হার মানিয়েছে আশুলিয়ার কমার্স ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায়। প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রাহক সেজেই ব্যাংকে ঢুকেছিল দুর্বৃত্তরা। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি একটু পরেই চোখের সামনে ঘটে যাবে বিভীষিকাময় ঘটনা। অন্যান্য দিনের মতোই চলছিল ব্যাংকের কার্যক্রম। ম্যানেজার ওয়ালিউল্লাহসহ অন্যরা ছিলেন নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ব্যাংকের ভেতরে গ্রাহকও ছিলেন ১৫-১৬ জনের মতো। কিন্তু দুপুর ২টার দিকে হঠাৎই পাল্টে যায় ব্যাংকের ভেতরের দৃশ্যপট। গ্রাহক সেজে ভেতরে ঢোকা ৪-৫ জন যুবক আসলে গ্রাহক ছিল না। মুহূর্তেই প্রত্যেকে ব্যাগ থেকে বের করে অস্ত্র। কারও হাতে ধারালো ছোরা, কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। হাতে ছিল গ্রেনেডও। পরিকল্পনা অনুযায়ী একজন জিম্মি করে ফেলে ব্যাংকের ম্যানেজার ওয়ালি উল্লাহকে। একজন জিম্মি করে নিরাপত্তারক্ষী বদরুল আলমকে। অন্যরা ততক্ষণে সবাই ঘটনার বিহ্বলতায় স্থির। দুর্বৃত্তরা সবাইকে শুয়ে পড়তে বলে। অনেকেই শুয়ে পড়ে মেঝেতে। দুর্বৃত্তরা ভল্টের চাবি নেয়ার চেষ্টা করে ম্যানেজারের কাছ থেকে। অন্যরা ক্যাশে থাকা টাকা-পয়সা সব নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। এদিকে ভেতরে থাকা গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ব্যাংক গ্রাহক পলাশের সহযোগী একজন বাইরে অবস্থান করছিলেন। তিনি ভেতরে যেতে গিয়ে দেখতে পান ব্যাংকের মূল দরজা তালাবদ্ধ। বুঝতে পারেন ভেতরে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। বাইরে থেকে চিৎকার করেন ডাকাত ডাকাত বলে। পাশের মসজিদ থেকে খাদেম তৈয়ব আলী এগিয়ে যান রড হাতে। সঙ্গে আরও গোটা সাত-আট জন মানুষ। ব্যাংকের বাথরুমের জানালা দিয়ে কেউ একজন ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করছিলেন। বলছিলেন মাইকে কিছু একটা ঘোষণা দিতে। খাদেম তৈয়ব আলীর মাথায় হঠাৎ মাইক শব্দটি কানে আসে। তিনি দৌড়ে চলে যান মসজিদের ভেতর। মাইক চালু করেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘কমার্স ব্যাংকে ডাকাত ঢুকছে, সবাই এগিয়ে আসেন’। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাজারের লোকজন ছুটে আসে ব্যাংকের সামনে। এগিয়ে আসেন আশেপাশের বসতবাড়ির লোকজনও। ব্যাংকের ভেতরে ততক্ষণে ঘটে গেছে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ভল্টের চাবি না দেয়ায় ম্যানেজারকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। বাধা দিতে এগিয়ে আসায় নির্মমভাবে কোপানো হয় নিরাপত্তারক্ষী বদরুলকেও। একইভাবে কোপানো হয় গ্রাহক পলাশকেও। বাইরে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি দেখে মাথা বিগড়ে যায় দুর্বৃত্তদেরও। বন্ধ গেটের ভেতর থেকেই তারা বাইরের লোকজনের উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি গুলি আর বোমা ছুড়ে মারে। ব্যাংকের ভেতরেও ফাটানো হয় হ্যান্ড মেইড গ্রেনেড। পরে তালা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসে দুর্বৃত্তরা। এলোপাতাড়ি গুলি আর বোমা ফাটিয়ে ছুটতে থাকে মূল রাস্তার দিকে। সেখানে মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করা অন্যরাও বোমা আর গুলি ছুড়তে থাকে। তবে পালিয়ে যাওয়ার সময় এক মোটরসাইকেলে থাকা তিন দুর্বৃত্তকে ধরে ফেলে স্থানীয়রা। এদের একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে স্থানীয় লোকজন। অপর দুই দুর্বৃত্ত বোরহান মৃধা (৩৫) ও সাইফুল (২৫)কে আটক করে পুলিশ। পালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের গুলি ও বোমায় মারা যান ৫ জন। এদের তিনজন ঘটনাস্থলে এবং দু’জন মারা যান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। ভয়াবহ এমন ব্যাংক লুটের ঘটনা এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটেছে বলে কেউ মনে করতে পারছে না। প্রকাশ্য দিবালোকে রীতিমতো ফিল্মি স্টাইলে ব্যাংক লুটের এ ঘটনায় হতচকিত খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। তারাও হিসাব মিলাতে পারছে না, কারা এবং ঠিক কি উদ্দেশ্যে জনবহুল এক বাজারের ভেতরের ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা করেছিল দুর্বৃত্তরা। কেন দুর্বৃত্তরা এই ব্যাংককেই বেছে নিয়েছিল লুট করতে। হিসাব মেলাতে পারছেন না তারাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, এটি নিছক একটি ব্যাংক ডাকাতি নয়, এর নেপথ্যে অন্য কোন কারণ রয়েছে। একই কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নূরুজ্জামানও বলেছেন, এর পেছনে অন্য কারণ রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত এক ডাকাতের সঙ্গে শিবিরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেন তিনি। বলছেন, গ্রেপ্তারকৃতরা অসংলগ্ন তথ্য দিচ্ছে। তাদের তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
কাঠগড়া এলাকায় সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ব্যাংকটির প্রধান ফটকে বুধবারও তালা ঝুলানো। পাশেই নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশের একাধিক দল। ব্যাংকের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা গেছে রক্তের দাগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফ্লোরে। ওই এলাকার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। সবার চোখে মুখে শোক আর আতংকের ছাপ। কাঠগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে নিহত সাহাবুদ্দিন মোল্লা পলাশের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পলাশের প্রতিবেশী জুয়েল বলেন, পলাশ ছিল নিঃসন্তান। তিনি ছিলেন গ্লোরিয়াস ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সেদিন ব্যাংকে গিয়েছিলেন এক লাখ টাকা ওঠাতে। সেখানেই ডাকাতরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে।
এদিকে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নূরুজ্জামান বলেন, ডাকাতদের ব্যবহার করা অস্ত্র খুবই আধুনিক। যেগুলো জঙ্গিরাই বেশি ব্যবহার করে। ডাকাতদের ব্যবহার করা বোমা দেশের বাইরে থেকে আনা হয়েছিল বলে তারা ধারণা করছেন। বাজারে এইসব অস্ত্র পাওয়া যায় না। এগুলো শুধু সেনাবাহিনী ব্যবহার করে। তিনি আরো জানান, গ্রেপ্তার হওয়া ডাকাত দলের সদস্য বোরহানের পুরো পরিবার জামায়াত- শিবিরের সঙ্গে জড়িত। দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতেই তারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ডিআইজি বলেন, ব্যাংকের সিসিটিভি সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ডাকাতির ঘটনায় স্থানীয়দের কোন হয়রানি করবে না পুলিশ এবং ডাকাতি প্রতিরোধে আহত-নিহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার বহন করবে।
গ্রেপ্তারকৃত দু’জন অসংলগ্ন তথ্য দিচ্ছেন: এনাম মেডিক্যালের সাত তলায় মুখোমুখি দুইটা কেবিনে চিকিৎসা হচ্ছে ডাকাতির ঘটনায় আটক বোরহান ও সাইফুলের। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অসংলগ্ন তথ্য দিচ্ছেন। বোরহান মৃধা নামে একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার শংকরপাশা গ্রামে। তার বাবার নাম হাজী আবুল কালাম মৃধা। সে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল তার গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিরি হরেন্দ্রবাজার গ্রামের আনোয়ারের ছেলে বলে জানিয়েছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা অব্যাহত জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছে তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বোরহান ডাকাতির কথা স্বীকার করেনি। এমনকি সাইফুলকে সে চেনে না বলেও জানিয়েছে। তবে সাইফুল জানায়, তারা কয়েকজন মিলে ডাকাতির পরিকল্পনা করে। সোমবার তুরাগের ইজতেমা মাঠে বসে তারা ডাকাতির পরিকল্পনা করে। তার দায়িত্ব ছিল শুধু বোমা ফাটানোর। তাদের সঙ্গে বরিশালের পাতার হাটের মারুফ, কাজল ও লিটন নামে আরো তিন জন ছিল। তাকে এক বড় ভাই ডাকাতি করতে নিয়ে এসেছিল বলে সে দাবি করে। সাইফুল জানায়, সে ডাকাতি করতে সঙ্গে না গেলে তাকে কথিত ওই বড় ভাই মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দু’জনই চতুর প্রকৃতির। তারা প্রকৃত তথ্য গোপন করে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়ার চেষ্টা করছে। গণধোলাইয়ের কারণে তাদের শারীরিক অবস্থা সুবিধার নয়। একারণে তাদের বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা যাচ্ছে না। সূত্র জানায়, বোরহানের বাবা আবুল কালাম মৃধা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে চাকরি করতেন। বোরহান কোরআনের হাফেজ। দীর্ঘদিন ধরে তার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। সে ঢাকায় কি কাজ করতো তা এলাকার লোকজন জানতো না। ঘটনার পর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বোরহানের বাবাকে কাশিয়ানী থানা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে।
আশুলিয়া থানায় দুই মামলা: বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের কাঠগড়া বাজার শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় আটককৃত ডাকাত সাইফুল ও বোরহানের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৮-১০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় উল্লেখ করা হয় ডাকাতির সঙ্গে জড়িতদের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। লুট হওয়া টাকার পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ৮৭ হাজার ১৯৩ টাকা। অন্যদিকে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত ডাকাত নিহত হওয়ার ঘটনায় আশুলিয়া থানা পুলিশের এসআই জাকারিয়া হোসেন বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ২০০-৩০০ জন স্থানীয় গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সেলিম হাসান জানান, টাকা বেশি খোয়া যায়নি। তবে ব্যাংকের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
চন্দ্রায় বোরহানের বাসায় অভিযান: বুধবার সকালে আশুলিয়া থানা পুলিশ ডাকাত বোরহানকে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার চন্দ্রা এলাকায় রমজান আলী শ্রমিক কলোনিতে অভিযান চালায়। ওই কলোনির একটি কক্ষে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকতেন বোরহান। ওই বাসা থেকে বেশ কিছু জিহাদি বই উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে আমাদের কালিয়াকৈর প্রতিনিধি জানান, বোরহান রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসায় ফিরত আর সকালে চলে যেত। তার গতিবিধি সবসময়ই সন্দেহজনক ছিল। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কম মেলামেশা করতো। তার চারটি পিকআপ, একটি ট্রাক ও একটি নীল রঙ্গের ডিসকভার মোটরসাইকেল ছিল। ট্রাকস্ট্যান্ডের ড্রাইভার শাহাবুদ্দিন জানান, প্রতি মাসেই তার গাড়ির ড্রাইভার পরিবর্তন করত। কোন পিকআপ মালিক সমিতির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না। আলাদা স্থানেই তার গাড়িগুলো রাখত। বাসার মালিক রমজান আলীর স্ত্রী রুপজান বলেন, বোরহান আমাদের বাসায় এসেছে দেড় মাস হবে। এর আগে সে আমার ভাই আফজালের বাসায় ভাড়া থাকত। দীর্ঘ ৩ বছর ওই বাসায় ভাড়া ছিল বলে তার কোন পরিচয় নেয়া হয়নি। ওর স্ত্রী পর্দা করতো কারও সঙ্গে তেমন মিশতো না। স্থানীয়রা জানান, ৬ মাস আগে জলিল নামে এক পিকআপ চালককে ওই এলাকার বাছেদের বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে দেয় রোবহান। সে তার স্ত্রী ও দুই বছরের মেয়ে তাসলিমাকে নিয়ে ওই বাসায় থাকত। জলিলের চলাচলও ছিল সন্দেহভাজনক। ডাকাতির ঘটনার পর থেকে জলিলকে আর দেখেনি এলাকাবাসী। ওই বাসার মালিক বাছেদ বলেন, আমার সঙ্গে তার তেমন কোন কথা হতো না। পিকআপ চালিয়ে রাতে আসত, সকালে যেত। বাড়ির ভাড়াটা তার স্ত্রী আমার স্ত্রীর কাছে দিয়ে যেত। ঘটনার পরপরই বোরহান ও জলিলের স্ত্রী বাসা ছেড়ে পালিয়েছে।
ডাকাতদের ধরলেন যারা: ঘটনার দিন স্থানীয় তিন যুবক রনি দেওয়ান, নয়ন দেওয়ান ও সোহেল মোল্যা ব্যাংকের পাশের একটি মাঠে আড্ডা দিচ্ছিল। এ সময় রনির এলিয়ন কার ও চালক হাসানও সঙ্গে ছিল। মসজিদের মাইকে ডাকাতির খবর শুনে তারা গাড়ি নিয়ে মূল রাস্তায় এগিয়ে যায়। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাদের একটি মোটরসাইকেল দেখিয়ে ডাকাত পালিয়ে যাচ্ছে বলে জানায়। এ সময় তারা নিজেদের এলিয়েন গাড়ি নিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে ধাওয়া করে। ব্যাংকের এক কিলোমিটার দূরে চৌরাস্তায় ডাকাত দলের মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দেয় তারা। মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিল বোরহান মৃধা। তার পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি ছিল। অন্যরা ছিল প্যান্ট-শার্ট পরা। গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেলটি পড়ে গেলে সাইফুলকে ধরে ফেলে রনি দেওয়ান। এর আগেই তারা প্রাইভেটকার লক্ষ্য করে একটি বোমা নিক্ষেপ করে। সাইফুলকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুজন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। নয়ন আর সোহেল তাদের ধাওয়া করে পাশের আড়াগাঁও পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাদের চিৎকারে আড়াগাঁওয়ের লোকজন সামনের দিকে বেরিকেড দিয়ে দুজনকে ধরে ফেলে। এ সময় স্থানীয়রা অজ্ঞাত একজনকে পিটিয়ে ঘটনাস্থলেই মেরে ফেলে। বোরহান সেখান থেকেও ছুটে পালানোর চেষ্টা করে। পরে তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় লোকজন। এদিকে রনি দেওয়ান মোটরসাইকেলের পাশে একটি ব্যাগে কিছু টাকা পড়ে থাকতে দেখে। এছাড়া ব্যাগের ২০ হাজার টাকা  ছিল সেখানে। আর তাজা বোমা তিনটি নিষ্ক্রিয় করে র‌্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। এদিকে ব্যাংকের পার্শ্ববর্তী মসজিদের খাদেম তৈয়ব আলী জানান, মসজিদ ও ব্যাংক মুখোমুখি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পান ব্যাংকের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একজন ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে চিৎকার করছে। প্রথমে তিনি রড হাতে এগিয়ে যান। এ সময় কেউ একজন তাকে মাইকে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলে। পরে তিনি দুই দফায় মাইকে ব্যাংকে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেন। তার আহ্বানেই এলাকাবাসী ব্যাংকের সামনে গিয়ে ডাকাতদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে।
পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর : ডাকাতদের নির্মম হত্যার শিকার ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জামালপুর জেলার সদর থানার অনন্তবাড়ী গ্রামের ওয়াসিম উদ্দিনের ছেলে ওলিউল্লাহর লাশ বুধবার সকালে নুরুল আলমের কাছে ঢামেক মর্গ থেকে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া ব্যাংকের নিরাপত্তা কর্মী বদরুল আলম, ডাকাতিতে বাধা দিতে গিয়ে নিহত ইব্রাহিম, সাহাবুদ্দিন পলাশ, নূর মোহাম্মদ, মনির হোসেন ও জমির উদ্দিনের লাশের ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে এখনও নিহত ডাকাতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ঘটনার দিনই পদোন্নতি হয়েছিল নিহত ম্যানেজারের: মঙ্গলবারই পদোন্নতি হয়েছিল নিহত ব্যাংক ম্যানেজার ওয়ালিউল্লাহর। জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির সেই চিঠি দুপুরে তার হাতে পৌঁছে ছিল। এ আনন্দ উপভোগ করার আগেই ব্যাংকে ঘটে যায় রোমহর্ষক ঘটনা। ওয়ালিউল্লাহর স্ত্রী মাহমুদা মেহাজাবিন বলেন, মঙ্গলবার সকালে অন্য দিনের মতো খাওয়া-দাওয়া করে ব্যাংকে গিয়েছিলেন তার স্বামী। দুপুরে ব্যাংক থেকে ফোন করে বলা হলো এনাম মেডিক্যালে যেতে। সেখানে যাওয়ার পর তিনি স্বামীর মৃত্যুর খবর পান।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা: আশুলিয়ার কাঠগড়ায় ভয়াবহ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি কিংবা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কোন গাফিলতি ছিল কি না তা খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য ঘটনার সরজমিনে তদন্তের স্বার্থে তিন সদস্যের একটি পরিদর্শন দল গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোয় নিরাপত্তা জোরদারের অনুরোধ জানিয়ে পুলিশের আইজিপিকে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) পাঠিয়েছেন গভর্নর। এছাড়া এ ঘটনায় নিহতের পরিবারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান প্রদানের ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি কমার্স ব্যাংক কর্তৃপক্ষকেও নিহতদের পুনর্বাসনে আর্থিক সহায়তা ও আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের নির্দেশনা দেন গভর্নর।

No comments

Powered by Blogger.