নাম বলা নিষেধ by সাজেদুল হক

বৃষ্টি অথবা প্রখর রোদ। ওরা ছুটছে নিরন্তর। জীর্ণ পোশাক। চেহারায় দারিদ্র্যের চাপ। তবুও হাসিখুশি ওরা। ওরাই এ বাংলাদেশের চালিকাশক্তি। বহু বছর আগে হুমায়ুন আজাদ এদের নাম দিয়েছিলেন বস্ত্রবালিকা। দৃষ্টি দিন দেশের বাইরে। কোথায় নেই তারা। মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ওরা বাংলাদেশী। বেশির ভাগই শ্রমজীবী। নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রিয় স্বদেশে। শ্রমিকের ঘামে দাঁড়িয়ে রয়েছে এ বাংলাদেশ। কিন্তু কেমন আছেন তাঁরা?
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন থেকে মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বুলবুল নামে এক বাংলাদেশীর লেখা চিঠিতেই স্পষ্ট তা। ১লা এপ্রিল নির্মাতা মোস্তফা সারয়ার ফারুকীকে ফেসবুকে তিনি চিঠিটি পাঠান প্রকাশের জন্য। তিনি লিখেছেন,
প্রিয় দেশবাসী, আসসালামু আলাইকুম, আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, আমরা বাংলাদেশী নাগরিক দুই হাজারের চেয়েও বেশি সানা ইয়েমেনে বসবাস করছি, এবং আদেন, তাইয, হুদাইদাহ, ইব্ব, মারেব, সাদা, ধামার, সবমিলে দশ হাজারের কাছাকাছি বসবাস করছি গোটা ইয়েমেনে। বর্তমানে ইয়েমেন সম্পর্কে সবাই অবগত আছে যে, সৌদি আরব এবং তার মিত্রবাহিনীসহ উপসাগরীয় দেশসমূহ সবাই মিলে ইয়েমেনে ওপর বিমান হামলা চালাচ্ছে, এমনকি আমরা এও শুনতে পাচ্ছি, তারা স্থলপথের দিকে এগোচ্ছে, এমতাবস্থায় আমাদের ইয়েমেন বসবাস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, গত এক সপ্তাহে প্রতিটি রাতে মুহুর্মুহু বিমান হামলা চলছে, সারারাত এক মিনিটের নিস্তার নেই, এক একটি রাত যেন মনে হয়, আজকের রাতই জীবনের শেষ রাত, চারপাশে শুধু বোমা আর গুলির আওয়াজ, প্রতিটি রাতই মনে হচ্ছে আজই জীবনের শেষ রাত।
আপনাদের সদয় অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, সকল দেশের সকল দূতাবাস এরই মধ্যে ইয়েমেন থেকে চলে গেছে এবং সকল দেশের সকল দূতাবাস তাদের সকল লোকজনকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, গত দুই দিন ভারত, পাকিস্তান ও তাদের নাগরিকদের নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে, যারা অবশিষ্ট আশে তাদেরও সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা চলছে, আমাদের ইয়েমেনে কোন দূতাবাস না থাকার কারণে আমরা গত দুই দিন ভারত, পাকিস্তান দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিলাম, কিন্তু তারা আমাদের স্রেফ জানায় তাদের নাগরিক ছাড়া অন্য কোন নাগরিকদের সহযোগিতা করতে অপারগ, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ হলেও। এখন আমরা বাংলাদেশীরা বর্তমানে খেয়ে না খেয়ে গত তিন দিন খুবই মানবেতর দিনযাপন করছি। এ মুহূর্তে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের আর বাঁচার কোন উপায় নেই, একমাত্র সরকারের সহযোগিতাই পারে আমাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে। সব দেশের সরকারেরা তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের নাগরিকদের যে কোন উপায়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের ভুল কি, আমরা কি বাংলাদেশী বলে? আমাদের জাতীয়তার কি কোন দাম নেই? আমরা প্রবাসীরা কি বাংলাদেশের একটি অংশ না??? আর কিছুই বলার নেই। যদি আমাদের দেশ মনে করে যে আমরা বাংলাদেশেরই একটা অংশ, দয়া করে আমাদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করুন। ইয়েমেন থেকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যত দ্রুত সম্ভব। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
কয়দিন আগে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন লিবিয়ায় দুই বাংলাদেশী শ্রমিক মিলিশিয়াদের হাতে বন্দি ছিল ১৮ দিন। তারা সৌভাগ্যবান। পরবর্তী সময়ে বন্দিদশা থেকে নিস্তার মিলে তাদের। যদিও এ ব্যাপারে এখনও বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। নিরাপত্তা বিবেচনায় লিবিয়া থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিকরা দেশে ফিরে গেলেও স্পষ্টত বাংলাদেশের শ্রমিকরা দেশে ফিরতে চাচ্ছেন না। জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও শুধু পরিবারের জীবিকার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য তারা সেখানে থেকে যাচ্ছেন। যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে প্রতিদিন কথার খই ফোটান তারা হয়তো এই মানুষদের জীবন সম্পর্কে অবগত নন।
২...
তিন মাসের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি শেষে বাংলাদেশ আপাতত কিছুটা শান্ত। যদিও অস্বস্তি রয়ে গেছে। বিরোধী জোট অবরোধ কর্মসূচি বহাল রাখলেও তা কার্যকারিতা হারিয়েছে। তিন মাসে পেট্রলবোমা আর ক্রসফায়ারে প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। বার্ন ইউনিটে মানুষের আর্তনাদ বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে যোগ করেছে নতুন অধ্যায়। ক্রসফায়ার আর গুম-খুনের মাত্রাও বেড়েছে বহু গুণ। নিখোঁজ হয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদসহ কমপক্ষে ২১ জন। এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পরিবারের জীবনের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার বয়ান উঠে এসেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলীর এক লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘সরকারের অস্বীকার করাই হচ্ছে বলপূর্বক গুমের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। প্রিয়জন হয়তো বহু বছর ধরে এক অনিশ্চয়তা নিয়ে বাঁচে, আশা আর নিরাশার দোলাচলে। মায়েরা চিন্তিত থাকেন, তাদের সন্তান যদি কখনও ফেরেও, তাহলে তাকে চেনা যাবে কিনা। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে যেসব নারী তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বামীর খোঁজে এখনও অপেক্ষায় আছেন, তাদের বলা হয় ‘অর্ধ-বিধবা’। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার জানিয়েছে, তারা শোকও প্রকাশ করতে পারেন না ঠিকঠাকভাবে। তারা অস্থির থাকেন এই ভেবে যে, তাদের প্রিয়জন কি এখন নির্যাতন ভোগ করছে, নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, কবরে শায়িত হওয়ার মর্যাদা কি সে পেয়েছে? আজকের বাংলাদেশে, বহু পরিবার এমন প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে রয়েছে।’ এ পরিস্থিতিতে মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে কমই। যদিও মাইনাসের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনরা সফল হলে এমন একটি নির্বাচন হতে পারে বলেও আলোচনা রয়েছে।
৩...
স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশের অর্জন একেবারে কম নয়। সবচেয়ে বড় অর্জন বিদেশনির্ভরতা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি আমরা। আর এ সাফল্যের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন গার্মেন্ট, অভিবাসী এবং কৃষি খাতের শ্রমজীবী মানুষেরা। বহু নতুন আর তরুণ উদ্যোক্তা এগিয়ে এসেছেন। রাষ্ট্র থেমে থাকলেও জনগণ এগিয়ে গেছে। অনেক রাজনীতিবিদ বুক ফুলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা বললেও তা যথেষ্ট কিনা এবং এতে তাদের অবদান কতটা সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্নে বাংলাদেশের অর্থনীতির কাছাকাছি আকার ছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির। কিন্তু চার দশক পর এসব দেশ অর্থনীতির অগ্রগতিতে যে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ তার তুলনায় তেমন কোন সাফল্যই পায়নি। সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও চিকিৎসা এবং শিক্ষার জন্য ক্ষমতাবানরা এখনও বিদেশেই ছুটছেন।
৪...
চার দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন খুব সম্ভবত ‘মুসলিম মেজরিটি ডেমোক্রেটিক’ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি। নানা চড়াই-উতরাই ছিল, নিষ্ঠুরতা ছিল, তার পরও ’৯০-এর পর থেকে গণতন্ত্রের পথে অবিচল ছিল বাংলাদেশ। যদিও নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সে গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ ছিল না। তবে যা ছিলও তাও যেন আজ নেই। একদিনের বাদশরা সর্বশেষ নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। শিগগিরই পারবেন তেমন কোন লক্ষণও নেই। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ঐতিহাসিক পদক্ষেপের পর গত দুই যুগে বাংলাদেশের মানুষ অন্তত মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু এখন সে স্বাধীনতাও হারানোর পথে। তার পরও আপনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করবেন এক শ্রেণীর সাংবাদিক টিভি টক শোতে গিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করছেন। প্রার্থী সন্ত্রাসী হলে জনগণ কেন তাকে ভোট দেবে তার পক্ষেও যুক্তি দেখাচ্ছিলেন এক সাংবাদিক। তবুও তার নাম লেখায় বলা যাবে না। এটাই বোধ হয় ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের’ সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

No comments

Powered by Blogger.