কলকাতায় নিস্তেজ মোদি হাওয়া by সুভাষ চন্দ্র

সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই কলকাতা পুরসভার ভোট৷ বিগত দু'দশক ধরে অদ্ভুত একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে৷ মহানগরের পুরভোটে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, পরের বিধানসভা নির্বাচনেও শেষ হাসিটা তারাই হাসে৷ শহরে গোটা রাজ্যের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ লোক বাস করে, তাই এই যুক্তিকে নেহাতই সমাপতন বলে অনেকে উড়িয়ে দিতে চাইবেন৷ কিন্তু আমি বলব, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বিধানসভা ভোটে রাজ্যকে পথ দেখান মহানগরের বাসিন্দারা৷ ২০১৬ বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে ক্রমশ তাদের অবস্থান মজবুত করে নিতে চাইছে বিজেপি৷ এই অবস্থায় আসন্ন পুর নির্বাচন তৃণমূল নেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে 'লিটমাস টেস্ট', রাজনীতির আঙিনায় মর্যাদার লড়াই৷ সারদা কাঁটা থেকে মুকুল রায়কে ঘিরে একরাশ অনিশ্চয়তা৷ দলে ইতিউতি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকে টিকিট না-পেয়ে বিক্ষুব্ধ গোঁজ প্রার্থীর খোঁচা৷ এমন একাধিক ইস্যু সঙ্গী করে আসন্ন পুরভোটে শাসক তৃণমূল কি ধরে রাখতে পারবে মসনদ? নাকি পদ্মগন্ধে মাতবে শহর কলকাতা?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মার্কেট রিসার্চ সংস্থা 'ইপসোস'কে দিয়ে করানো 'এই সময়'-এর সমীক্ষার প্রথম পর্বে যে ইঙ্গিত মিলেছে, তাতে বিরোধী ভোট একজোট না হওয়ায় এ বারও কার্যত ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে বড় মার্জিনেই পুরবোর্ড গড়তে চলেছে তৃণমূল৷ যাতে গতবারের থেকেও আসন বাড়ার সম্ভাবনা থাকছে তাদের৷ সামগ্রিক ভাবে শহরের ৫৬% ভোটার মনে করছেন, বিগত পুরবোর্ডের দেওয়া নাগরিক পরিষেবায় তাঁরা সন্তুষ্ট, যেখানে অসন্তুষ্টের পরিমাণ মাত্রই ১৫%৷ এই মানসিকতা ভোটের দিন অবধি বজায় থাকবে ধরে নিলে, আরও পাঁচ বছরের জন্য পুরবোর্ড হাসতে হাসতে পকেটে পোরা উচিত তৃণমূলের৷
বিগত পুরসভার সামগ্রিক কাজে খুশি-অখুশির দলভিত্তিক তালিকায় নজর দিলে তৃণমূলের মজবুত অবস্থা আরও সহজে বোঝা যাবে৷ জোড়াফুলে যেখানে ৭২% 'খুশি' ভোটার ফের ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন, সেখানে বিজেপি ৪৩% 'খুশি' ভোটার নিয়ে বেশ খানিকটা পিছনে৷
সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে মনে করা হচ্ছে, সার্বিক ভাবে ২০১০ পুরভোটের তুলনায় ৩% ভোট কমলেও অন্তত ৪৫% ভোট নিয়ে ফের ক্ষমতায় আসতে পারে তৃণমূল৷ প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে বিরোধী বামেদের ভোট কমে দাঁড়াতে পারে ২৭%৷ সেক্ষেত্রে এটা পরিষ্কার রাজ্যে আরও একটি নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটতে চলেছে বামেদের৷ একই সঙ্গে এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে, তৃণমূল-বিরোধী ভোটব্যাঙ্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কিন্তু তারা ধরে রাখতে পারেনি, যা পকেটে পুরেছে বিজেপি৷ এমন ধারা চলতে থাকলে আগামী দিনে রাজ্যে বামেদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে৷
তবে বাম ভোটে থাবা বসালেও টুকটাক দু'-একটা খুচরো আসন ছাড়া এই পুরভোটে বিজেপির পক্ষে তেমন কিছু চমক দেখানো শক্ত৷ সমীক্ষা বলছে, বিজেপির ভোট ৭% বাড়লেও তা দু'সংখ্যায় পৌঁছবে না বলেই অনুমান৷ সেক্ষেত্রে বিগত লোকসভা নির্বাচনে ভোটের ধারা বজায় রাখতে না-পেরে পুরসভায় প্রধান বিরোধী হিসেবে বামেদের সরানো এ বার সম্ভব হচ্ছে না বিজেপির৷ এক্ষেত্রে কিছুটা দায়ী মোদির অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর আর কিছুটা নিচুতলার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুরোনো ভোটারদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ৷ একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য৷ এবারই প্রথম ভোট দিতে যাওয়া ভোটারদের মধ্যে কিন্ত্ত এখনও মোদি-ম্যাজিক কাজ করার প্রমাণ মিলেছে৷ এই শ্রেণির ভোটারদের মধ্যে তৃণমূলকে (৩১%) বেশ খানিকটা পিছনে ফেলে দিয়েছে বিজেপি (৩৮%)৷ কিন্তু সামগ্রিক সংখ্যার বিচারে নতুন ভোটারদের সংখ্যা নির্ণায়ক মাত্রায় পৌঁছতে পারেনি৷ যার ফলে এর প্রভাব সামগ্রিক ভাবে ভোটের ফলে পড়বে না৷ সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক চিরকালই তৃণমূলের প্লাস-পয়েন্ট৷
সেই ভোটারদের মধ্যেই সবথেকে বেশি অসন্তোষ লক্ষ্য করা গেলেও (খুশি ২৩%, হিন্দুরা যেখানে জানাচ্ছেন ৫৯% খুশি), সেই ফায়দাটা যে বাম শিবির তুলতে পারবে না, তারও ইঙ্গিত মিলেছে সমীক্ষায়৷ রাজ্য সরকারের কাজে প্রতি পাঁচ জনে একজন ও পুরসভার কাজে প্রতি চার জনে এক জন সংখ্যালঘু ভোটার সন্তোষপ্রকাশ করলেও গরিষ্ঠ অংশের সংখ্যালঘু ভোটার কিন্তু এবারও শিবির বদলের কথা ভাবছেন না (মাত্র ১০% বাম শিবিরে যেতে চান)৷ বরঞ্চ বাম-ভোটে বড় থাবা বসাতে পারে বিজেপি৷ এক্ষেত্রে তৃণমূলের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে অন্য একটা ব্যাপার৷ আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এআইইউডিএফ বা এমআইএম-এর মতো সংখ্যালঘু দল আলাদা ভাবে লড়লে ভোট কাটাকাটিতে কমতে পারে শাসকদলের আসন৷
মহানগরকে উত্তর কলকাতা (জোন-১), উত্তর-পশ্চিম ও মধ্য কলকাতা (জোন-২), উত্তর পূর্ব ও মধ্য কলকাতা (জোন-৩), দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতা (জোন-৪) এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম কলকাতা (জোন-৫) এই পাঁচটি অংশে ভেঙে ১৫টি বরোর ৩২টি ওয়ার্ডকে বেছে নেওয়া হয়েছিল সমীক্ষার জন্য৷ কথা বলা হয়েছিল ৮০১ জনের সঙ্গে৷
এই সমীক্ষা চালানোর সময় মাথায় রাখা হয়েছিল আরও দু'টি বিষয়কে৷ প্রথমত, আয়ের মাপকাঠিতে ভোটারদের ধনী থেকে গরিব পাঁচটি শ্রেণিতে এবং দ্বিতীয়ত বয়সের বিচারে ভোটারদের ১৮-২৫, ২৬-৩৫, ৩৬-৪৫, ৪৬-৬০ এবং তদুর্ধ্ব শ্রেণিতে ভাগ করে মতামত নেওয়া হয়েছিল৷ সমীক্ষায় সংগ্রহ করা হয়েছিল নির্দিষ্ট কিছু তথ্য৷ যা বিশ্লেষণ করে উঠে এসেছে পুর-পরিষেবাগুলি, যেগুলো প্রভাবিত করছে ভোটারদের৷ দেখা যাচ্ছে, জল সরবরাহ (২১%), পথেঘাটে আবর্জনা জমা (১৬%), নিকাশি (খোলা নিকাশি ৮% এবং বুজে যাওয়া ড্রেন ৮%) এবং জল জমাকেই (৮%) সবথেকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ভোটাররা৷ ফল জানতে বেশিদিন আর অপেক্ষা করতে হবে না৷ কিন্তু এটা ঠিক, পুরসভা দখল করলে বিধানসভা দখল করার দিকেও অনেকটা এগিয়ে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী৷
লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ইপসোস রিসার্চ প্রাইভেট লিমিটেড
সূত্র: কলকাতার দৈনিক এই সময়

No comments

Powered by Blogger.