তিস্তায় বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা by মো. আরফান উজ্জামান ও কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে যে কয়টি বিষয় নিয়ে খুব বেশি টানাপোড়েন চলছে, তার মধ্যে তিস্তা ইস্যু একটি। উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন তিস্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে তিস্তা অববাহিকার ৫ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই তিস্তার পানির প্রবাহ কমে যাওয়া আমাদের জীবন ও জীবিকায় আঘাতস্বরূপ। তিস্তা অববাহিকার ৮ হাজার ৫১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ ৪ হাজার ১০৮ বর্গ কিলোমিটার, যার প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশই তিস্তার পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত এই মুহূর্তে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ তিস্তার পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেওয়ার কাজে।
এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তা আজ মরা নদীতে পরিণত হয়েছে
কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে গেছে। এর দরুন তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি উপজেলা যেমন: ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী সদর, সৈয়দপুর, রংপুর সদর, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, গঙ্গাচরা, পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর ও খানসামা, যারা তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি জমিতে সেচসুবিধা পেয়ে থাকে, তাদের কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এখানে বলা প্রয়োজন, আউশ ও আমন মৌসুমে ভারতের পানি প্রত্যাহারের পরও তিস্তা নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে, যার ফলে সেচ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয় না। তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ শুধু শুষ্ক মৌসুমে বোরো উৎপাদনের ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ শুষ্ক মৌসুমে অন্যান্য সময়ের তুলনায় তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ কম থাকে। ভারত তার ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমির সেচের চাহিদা মিটিয়ে যে পরিমাণ পানি ছাড়ে, তা দিয়ে বোরো মৌসুমে আমাদের সেচ চাহিদার অর্ধেকও পূরণ করা যায় না। ১৯৯৭ সালে বাংলদেশে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানির প্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কিউসেক, যা ২০০৬ সালে নেমে আসে ১ হাজার ৩৪৮ কিউসেকে এবং ২০১৪ সালে পানির প্রবাহ এসে দাঁড়ায় মাত্র ৭০০ কিউসেক, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
মরে গেছে তিস্তা, নৌকা চলার মতো পানিটুকুও নেই তিস্তায়
এখন আসা যাক শুষ্ক মৌসুমে পানি কম পাওয়ার কারণে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি কতটুকু হচ্ছে তার পরিমাণের ওপর। ১৯৯৩-৯৪ শস্যবছর থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি উপজেলায় ব্যাপকভাবে আউশ ও আমন উৎপাদনের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০০৬-০৭ শস্যবছর থেকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বোরো মৌসুমেও সেচ কার্যক্রম প্রসারিত করা হয়। আমন মৌসুমে মোট সেচযোগ্য ৭৯ হাজার ৩৭৯ হেক্টর এলাকার প্রায় সম্পূর্ণটাই সেচের আওতায় আনা সম্ভব হলেও বোরোর ক্ষেত্রে পানির দুষ্প্রাপ্যতায় সেচ-সাফল্যের চিত্র একেবারেই হতাশাজনক। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৬-০৭, ২০০৮-০৯ ও ২০১৩-১৪ শস্যবছরে সর্বমোট সেচযোগ্য ৭৯ হাজার ৩৭৯ হেক্টর জমির মধ্যে যথাক্রমে মাত্র ১১ হাজার ৩২৩, ২৯ হাজার ৪২৫ ও ২৭ হাজার ৪৮৬ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যা মোট সেচযোগ্য জমির মাত্র ১৪ শতাংশ, ৩৭ শতাংশ ও ৩৫ শতাংশ। যেহেতু তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকায় নদীর পানি ছাড়া অন্য কোনো সেচের ব্যবস্থা নেই, তাই প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ জমি চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে পানির অভাবে সেচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার কারণে ধানগাছ শুকিয়ে মারা যাচ্ছে, এতে করে বীজতলা তৈরি ও উন্নতমানের বীজ ক্রয়ে কৃষকের করা বিনিয়োগ নষ্ট হচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষক প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে তাঁদের জীবনমানে।
প্রমত্তা তিস্তা যেন মরুভূমি, নেই পানি, কৃষকের হাহাকার
আমাদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিস্তা নদীতে পানির সংকটের কারণে সর্বমোট ৪২ লাখ ৫৪ হাজার ২১৮ মেট্রিক টন বোরো ধান আমরা উৎপাদন করতে পারিনি। চলতি বাজারমূল্যে এর পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকার ওপরে, যা নিঃসন্দেহে আমাদের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারত, শক্তিশালী করতে পারত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা বলয় এবং একইভাবে বাড়াতে পারত অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থকা ওই অঞ্চলের কৃষকদের আয়। তিস্তায় পানির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও আরেক ধরেনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা, যা সচরাচর বলা হয় না, আর হলেও যে ব্যাপকতায় বলা দরকার, সেভাবে বলা হচ্ছে না, আর তা হচ্ছে পরিবেশগত ক্ষতি।
তিস্তা এখন আর নদী নয়, একটি মরা খাল
২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছরের মধ্যে পাঁচ বছরই শুকনো মৌসুমে তিস্তা নদীতে কার্যত কোনো পানি ছিল না। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, শুকনো সময়ে যে সামান্য পরিমাণ পানি ভারতের প্রত্যাহারের পর তিস্তা নদীতে পাওয়া যায়, তার সবটুকুই সেচ চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক শ সেচ খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর দরুন ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজের পর থেকে ৯৭ কিলোমিটার বিস্তৃত তিস্তা নদীতে এক কিউসেক পানিও থাকছে না। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের এই বিশাল পরিমাণ নদীগর্ভ পরিণত হচ্ছে বালুচরে। তিস্তা ব্যারাজ এলাকার পর শুকনো মৌসুমে এভাবেই নদী মারা যাচ্ছে। যেহেতু তিস্তা নদী উত্তরাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তাই যমুনা নদীর পানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তিস্তা নদী থেকেও বাহিত হয়। তিস্তা নদী যখন শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে, তখন যমুনা নদীতেও পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে তিস্তা নদীর যে প্রাকৃতিক কার্যাবলি আছে, শুকনো মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে তা বিঘ্নিত হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে নদী অববাহিকায় প্রতিবেশগত ভারসাম্য এবং সর্বোপরি তিস্তা হারাচ্ছে তার অতীত পরিবেশগত সক্ষমতা।
অকার্যকর হয়ে পড়েছে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিস্তা নদী যখন শুকিয়ে যায়, তখন নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যও প্রবল হুমকির সম্মুখীন হয়। এই তিস্তা নদীতে একসময় ইলিশ মাছ পর্যন্ত অহরহ পাওয়া যেত, কিন্তু এখন ইলিশ মাছ তো নয়ই, অন্য প্রজাতির বড় মাছও দুর্লভ হয়ে গেছে। অপর দিকে নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, রংপুর ও ডালিয়ার আশপাশে যেসব এলাকায় আগে মাটির ৩৫-৪০ ফুট গভীরে ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যেত, তা এখন ৬০-৬৫ ফুট বা জায়গাভেদে তার চেয়েও নিচে নেমে গেছে। এর দরুন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য এলাকার কৃষক, যাঁরা সরাসরি তিস্তার পানি পান না এবং সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেন, তাঁদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজে পানির জন্য হাহাকার
আরেকটি কথা না বললেই নয়, যেহেতু উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তিস্তার মতো এত বড় নদী আর নেই, তাই ওই অঞ্চলের জলবায়ুর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তিস্তা নদীর ওপর নির্ভর করে। তাই তিস্তা নদী যদি এভাবে প্রায় প্রতিবছরই পানির অভাবে শুকিয়ে যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জলবায়ুও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই পরিবেশগত কারণেও তিস্তা নদীর অসীম মূল্য রয়েছে, যা নিয়ে আরও বৃহৎ পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন। তিস্তা অববাহিকায় শুষ্ক মৌসুমে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় নদীতে সব সময় ৫৫০ থেকে ৭০০ কিউসেক এবং বোরোর চাহিদা পূরণে আমাদের অন্তত চার হাজার কিউসেক পানি দরকার।
পরিশেষে যেটা বলতে চাইছি তা হলো, আমাদের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি প্রশমনের জন্য অবিলম্বে স্বচ্ছতা ও সমতার ভিত্তিতে তিস্তার পানি চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। তিস্তা চুক্তি যতই প্রলম্বিত হবে, আমাদের ক্ষতির পরিমাণ ততই বাড়বে এবং বাংলাদেশের ক্ষতির বিপরীতে ভারতই লাভবান হতে থাকবে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে যতটুকু অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তার পরিমাণ নিরূপণ করে ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করা অপরিহার্য। আমরা যদি আমাদের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ক্ষতিপূরণ না চাই, তাহলে ভারত ও তার জনগণ প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারবে না। আলোচনার টেবিলে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার তথ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরাটা আরও বেশি যুক্তিসংগত ও ফলপ্রসূ হবে। তিস্তায় পানির দুষ্প্রাপ্যতা নিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণাটি পরিচালিত হওয়ার আগে আমাদের হাতে তিস্তার পানির অভাবে আঞ্চলিক কৃষিতে প্রভাব কতটুকু পড়ছে, তার ক্ষতির প্রকৃত কোনো পরিসংখ্যান ছিল না। এখন আশা করা যাচ্ছে যে এই ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে জোরালো বক্তব্য রাখতে সমর্থ হবে এবং তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সক্ষম হবে।
মো. আরফান উজ্জামান: গবেষক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিস।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: অর্থনীতিবিদ, চেয়ারম্যান, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস।

No comments

Powered by Blogger.