ঢাকা দক্ষিণের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড, সমস্যার শেষ নেই যেখানে by অরূপ দত্ত

বাসার পানিতে গন্ধ। স্কুলের টিফিন বিরতিতে খাওয়ার জন্য
রাস্তার কল থেকে বোতলে পানি নিচ্ছে দুই শিক্ষার্থী। ছবিটি
সম্প্রতি শাঁখারীবাজার এলাকা থেকে তোলা l হাসান রাজা
ভাঙা রাস্তা। ফুটপাত নেই। রিকশা, ঠেলা গাড়ি, পথচারী একযোগে চলাচল করছে। আটকে আছে ময়লা পানি। গিঞ্জি গলি, ছোট্ট ঘর, মানুষ বেশি, ভাড়া বেশি। আছে জরাজীর্ণ বাড়ি ভেঙে পড়ার আতঙ্ক।
একসঙ্গে এত সমস্যা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে। এসব সমস্যা দেখার যেন কেউ নেই। গত সোমবার ওয়ার্ড এলাকা ঘুরে বাসিন্দা, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব সমস্যার চিত্র পাওয়া যায়। সমস্যা আরও আছে। বাসার পানিতে দুর্গন্ধ। রাস্তার কলের পানি সংগ্রহ করতে হয় স্কুলে পড়া ছোট শিশুদেরও। বিনা নোটিশে বিদ্যুৎ চলে যায়, চুলায় গ্যাসের আঁচ থাকে না।
এই ওয়ার্ডে রয়েছে আশেক লেন, রাধিকা মোহন বসাক লেন, হরি প্রসন্ন মিত্র রোড, সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেন, কোর্ট হাউস স্ট্রিট, উচ্ছব পোদ্দার লেন, প্রসন্ন পোদ্দার লেন, রাখাল চন্দ্র বসাক লেন, বাঁশিচরণ সেন পোদ্দার লেন, ইসলামপুরের একাংশ, নবরায় লেন, কৈলাশ ঘোষ লেন, শাঁখারীবাজারের একাংশ, রাজার দেউড়ি, কোর্টকাচারি, রায়সাহেব বাজার। জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। ভোটার মাত্র ১৭ হাজার ৩১০ জন। এঁদের মধ্যে পুরুষ ৯ হাজার ৬৯৪, মহিলা ৭ হাজার ৬১৬ জন। কেমন আছেন—জানতে চাইলে বেশির ভাগই সরাসরি বললেন, ‘বেঁচে আছি।’
ভাঙা রাস্তা, আবর্জনা, ময়লা পানি: ভাঙা রাস্তায় এমনিতেই চলা কষ্ট। রোববার রাতে বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তার ধারে সেই বৃষ্টির পানি জমে আছে সোমবারও। সঙ্গে মিশেছে পয়োনালার পানি। চারদিকে দুর্গন্ধ। কোথাও জমে আছে কাদা।
দুপুর ১২টার দিকে রাজার দেউড়ি, কোর্ট হাউস স্ট্রিট এলাকায় এমন দৃশ্য দেখা গেল। আট ফুটের এ রাস্তায় চলাচল করছে রিকশা, ঠেলা গাড়ি ও ব্যক্তিগত গাড়ি। এই অবস্থায় থেমে থেমে চলছেন পথচারী। বেহাল রাস্তা রাধিকা মোহন বসাক লেন, হরি প্রসন্ন মিত্র রোড, সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেন, প্রসন্ন পোদ্দার লেনেও। পুরো ওয়ার্ডে কিছুটা ভালো দেখা গেল ইংলিশ রোড প্রান্ত থেকে তাঁতীবাজারের প্রধান রাস্তাটি। মাস চারেক আগে প্রায় ২০ লাখ টাকায় এখানে প্রায় ৮০ মিটার দীর্ঘ রাস্তা ও দুই পাশের নর্দমা পাইপ সংস্কার করা হয়েছিল।
প্রধান রাস্তায় দেখা না গেলেও পানিটোলা, রাধিকা বসাক লেন, আওলাদ হোসেন লেন, উচ্ছব পোদ্দার লেনে দেখা যায়, রাস্তায় পয়োনালার পানি ছড়িয়ে আছে। শাঁখারীবাজারের মুখে, কালীমন্দিরের বিপরীত দিকের গলিতে, প্রসন্ন পোদ্দার লেনে আবর্জনার স্তূপ দেখা যায়। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানান, সিটি করপোরেশনের ওপর ভরসা না করে পাড়ায় পাড়ায় নিজেদের উদ্যোগে ময়লা সরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাসে ৬০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। সেই ময়লা নিয়ে রাখা হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে। এর পরও করপোরেশন তা সময়মতো সরিয়ে নেয় না।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিএসসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিয়মিতই ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে থাকেন। তবে নির্ধারিত কনটেইনারে আবর্জনা না ফেলে যেখানে-সেখানে ফেললে সমস্যা হয়।
পানির কষ্ট: সোমবার সকাল ১০টার দিকে বাহাদুর শাহ পার্ক প্রান্তের শাঁখারীবাজার শনির মন্দিরের রাস্তার কল থেকে ছোট্ট বোতলে পানি ভরছিল স্কুলছাত্র অমিত ও সুজন। বলল, বাসার ট্যাপের জল খেলে পেটে সমস্যা হয়। স্নান করে গায়ে গোটা হয়েছে। স্কুলে টিফিনের বিরতিতে খাওয়ার জন্য এভাবে প্রতিদিন জল নেয়।
স্থানীয় এরশাদ হল এবং প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের ধোলাইখাল এলাকার পানির পাম্প থেকে আগে এই এলাকায় পানি আসত। কিন্তু পুরো এলাকার জন্য তা পর্যাপ্ত ছিল না। মাস খানেক আগে রাজার দেউড়িতে একটি গভীর নলকূপ বসানো হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। বাসিন্দা তরুণ ঘোষ দুঃখ করে বলেন, ‘এলাকার পানির কষ্ট বোধ হয় সারা জীবনের। কল খুললে ময়লা ও দুর্গন্ধ পানি আসে। কিছু করার নেই, তার পরও প্রতিমাসে পানির বিল দিতে গিয়ে বিরক্তি আসে।’
ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ বি এম কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, অবৈধ সংযোগের কারণে অনেক সময় পাইপ ফুটো হয়ে যায়, সে পথে ময়লা ঢুকে থাকতে পারে। যেটা ঢাকার অনেক স্থানেই হয়।
তবে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডবাসী ওয়াসার এই যুক্তির সঙ্গে একমত নন। তাঁরা বলেন, এলাকায় এখন পর্যন্ত পাকিস্তান আমলের পাইপলাইন রয়েছে।
রাজার দেউড়ির তরুণ ঘোষ ছাড়াও কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এলাকায় ছোট ছোট ঘর, কিন্তু মানুষ অনেক বেশি। চার শ, পাঁচ শ বর্গফুটের বাসার জন্য অগ্রিম দিতে হয় এক লাখ টাকার ওপরে। সঙ্গে সব বিল।
শাঁখারীবাজার ও আশপাশের এলাকাকে ২০০৯ সালে ‘ঐতিহ্যবাহী সংরক্ষিত এলাকা’ ঘোষণা করা হয়েছিল। এ জন্য কোনো ভবন ভাঙা যাবে না বলে আদেশও জারি হয়। বেশির ভাগ জরাজীর্ণ ভবন হলেও অনেকে সেসব ভবনেই বসবাস করছেন। তবে কিছু ব্যতিক্রমও দেখা যায়। ১৪ নম্বর ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ফ্ল্যাট বিক্রির বিশাল ব্যানার টানানো হয়েছে। পেছনের দিকে ভবনের বড় একটি অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। নির্মাণকারীরা বলেন, এখানে মন্দির ছিল, সেটিও সংস্কার করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.