নূর তারেকসহ অভিযুক্ত ৩৫ by রাজু আহমেদ

ঘটনার প্রায় এক বছরের মাথায় আদালতে দাখিল করা হল নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট)। মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ৩৫ জনের নাম রয়েছে অভিযোগপত্রে। নৃশংস এ খুনের ঘটনায় ফতুল্লা থানায় করা দুটি মামলার জন্য দুটি পৃথক চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। বুধবার বিকালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশীদ মণ্ডল নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদনী রূপমের আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করেন। আদালত চার্জশিট গ্রহণ করে ১১ মে শুনানির দিন ধার্য করেছেন। মামলার অভিযোগপত্রে যে ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে ২৫ জন র‌্যাব সদস্য। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৩ জনকে পলাতক দেখানো হয়েছে। বাকি ২২ জন কারাগারে রয়েছেন। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন ১২৭ জন। ১৬২ প্রকারের আলামত সংগ্রহ করে আদালতে জমা দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। মামলা থেকে এজাহারভুক্ত ৫ আসামিসহ বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া মোট ১৬ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এজাহারভুক্ত ৫ আসামিকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি।
অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামি হলেন- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন, থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রাজু, নূর হোসেনের অন্যতম ক্যাশিয়ার ও নিহত নজরুলের চাচা শ্বশুর হাসমত আলী হাসু, ইকবাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন।
সেলিনা ইসলাম বিউটি এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বুধবার আদালত চত্বরে গণমাধ্যমকে জানান, ২৭ এপ্রিল অপহরণের আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নজরুলের ওপর অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছিল ওই ৫ জন। তারা ওই ঘটনার পর নজরুল ইসলামকে ১৫ দিনের মধ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। হাজী ইয়াসিনের বাড়িতে বসে এ হত্যা পরিকল্পনার সভা হয়েছিল। যদি তারা এ ঘটনা নাই ঘটাবে তাহলে ওই পাঁচজনের পাসপোর্টে আগে থেকেই কেন বিদেশে যাওয়ার ভিসা লাগানো হয়েছিল? তিনি বলেন, অব্যাহতি পাওয়া এই পাঁচ আসামিই এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী। তাদের বাদ দেয়ার নেপথ্যে কোনো বিশেষ কারণ রয়েছে। ভারতে আটক নূর হোসেনকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে বিউটি বলেন, তাকে আনলেই সব তথ্য পাওয়া যাবে।
৭ খুনের ঘটনায় নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় একটি মামলা [নং-৭৪(৪)] করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে।
এ হত্যাকাণ্ডে ফতুল্লা থানায় অপর মামলাটি (নং-১১/৫) করেন নিহত সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামাদের।
বুধবার দাখিল করা দুই অভিযোগপত্রে খুব বেশি পার্থক্য নেই জানিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মণ্ডল জানান, যেহেতু দুটি মামলার ঘটনা একই এবং আসামিরাও এক, তাই অভিযোগপত্রে খুব বেশি পার্থক্য নেই। অভিযোগপত্রে প্রধান ও প্রথম অভিযুক্ত হিসেবে নাম দেয়া হয়েছে মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে কারাগারে বন্দি রয়েছেন- ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (অব.) মোহাম্মদ মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, এবি আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব, কনস্টেবল সিহাবুদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, হাবিলদার নাসির উদ্দিন, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হোসেন, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, নূর হোসেনের দেহরক্ষী মর্তুজা জামান চার্চিল, ক্যাশিয়ার আলী মোহাম্মদ, ড্রাইভার মিজানুর রহমান দীপু ওরফে মিজান, রহম আলী ও আবুল বাশার।
পলাতক অভিযুক্তরা হলেন- প্রধান আসামি নূর হোসেন, ভারতে আটক নূর হোসেনের সহযোগী ওয়াহিদুজ্জামান সেলিম ওরফে কিলার সেলিম, কর্পোরাল মোখলেসুর রহমান, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, এএসআই কামাল হেসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিব, নূর হোসেনের সহযোগী সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান ও জামাল উদ্দিন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, তদন্তে ৭ খুনের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া না যাওয়ায় মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হাজী ইয়াসিন, আমিনুল হক রাজু, হাসমত আলী হাসু, ইকবাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেনের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
এদিকে আদালত সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ১৭ র‌্যাব সদস্যসহ মোট ২১ জন হত্যাকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ততা ও অপরাধ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া সাক্ষী হিসেবে ১৮ জন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। সূত্র জানায়, অভিযোগপত্রে এ নৃশংস ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থের জোগানদাতা হিসেবে দেখানো হয়েছে নূর হোসেনকে। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবে রূপদানকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে র‌্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ ও কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফকে। লে. কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানা অপহরণে অংশ নিয়ে ঘটনায় আংশিক জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হত্যার পরিকল্পনা, ৭ জনকে অপহরণ, চেতনানাশক ইনজেকশন ও মুখে প্লাস্টিক বেঁধে খুন করা এবং লাশের সঙ্গে ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া, লাশ ট্রলারে উঠানোর সময় কাঁচপুরের ল্যান্ডিং স্টেশন এলাকায় পাহারা দেয়াসহ কয়েকটি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিত উদ্দিন। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের সঙ্গে ত্রুটিমুক্তভাবে এ মামলার তদন্ত শেষ করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে কাউকে জড়ানো বা ছাড় দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার, ব্যবসায়িক কোন্দল ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ৬ কোটি টাকা লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি তদন্তে উঠে এলেও সঠিক বা নির্দিষ্ট পরিমাণের বিষয়টি জানা যায়নি।
আদালত সূত্র জানায়, গোয়েন্দা পুলিশের দেয়া চার্জশিটের ভিত্তিতেই বিচার কাজ শুরু হবে। উচ্চ আদালতে দাখিল করা ৭ খুনের ঘটনায় র‌্যাবের নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদন এবং জনপ্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বিচারিক কার্যে প্রযোজ্য হবে না। কারণ উচ্চ আদালত এ ঘটনায় গাফিলতির বিষয়টি দেখতে অভ্যন্তরীণ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন, এটি হত্যাকাণ্ডের মূল তদন্ত প্রতিবেদন নয়।
এদিকে মামলার তদন্ত কালে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে প্রায় ১০ মাস ধরে কারাগারে বন্দি ১০ আসামিকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়ার ঘটনায় খুশি তাদের স্বজনরা। বন্দি সোনা মিয়ার স্ত্রী রাহিমা বেগম বুধবার আদালত চত্বরে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, আমার স্বামী নূর হোসেনের সন্তানদের স্কুলে আনা-নেয়ার কাজ করতেন। গত বছরের ৫ মে তাকে গ্রেফতারের পর থেকে তিনি জেলে বন্দি আছেন। পুলিশের তদন্তে আমরা খুশি।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের কাছ থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। পরের দিন ?নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন। মামলায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করা হয়েছিল।
অপহৃতদের মধ্যে ৩০ এপ্রিল ছয়জনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে। এর পরের দিন আরও একজনের লাশ শীতলক্ষ্যায় পাওয়া যায়। লাশ উদ্ধারের পর চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল একটি মামলা করেন।

No comments

Powered by Blogger.