আচরণবিধি লংঘন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই by কাজী জেবেল

তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থী ও বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ উঠছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখনও পর্যন্ত লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এমনকি কোনো কোনো আচরণবিধি লংঘনের ঘটনা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। শুধু শোকজ ও নামকাওয়াস্তে জরিমানার মধ্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা ও নির্বাচন কমিশন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠায় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারি সুবিধাভোগীরা যাতে প্রচারণায় অংশ না নেন- সে অনুরোধ জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সংসদ সচিবালয়কে বুধবার বিকালে চিঠি দিয়েছে ইসি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আজম নাছির উদ্দিনের পক্ষে সম্প্রতি নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নেয়ার অভিযোগ ওঠে। তবে তাদেরকে ওই অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। কমিশন অবশ্য দাবি করছে, প্রভাবশালী কারও বিরুদ্ধে আচরণবিধি লংঘনের কোনো অভিযোগ কমিশনে আসেনি। অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে। তবে ইসির কর্মকর্তারা বলেন, গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত আচরণবিধি লংঘনের চিত্র ও সংবাদ বের হচ্ছে। ড. এটিএম শামছুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও বিভিন্ন সোর্স থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আচরণবিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিতেন। এক্ষেত্রে বর্তমান কমিশন অনেকটা নমনীয় দেখা যাচ্ছে। আইন অনুযায়ী, আচরণবিধি লংঘনের ঘটনায় প্রার্থিতা বাতিলসহ সাজামূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।
বর্তমান প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বিভিন্ন সোর্স থেকে আচরণবিধি লংঘনের তথ্য নিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা তাই করেছিলাম। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লংঘনের ঘটনাগুলোতে কমিশনকে অ্যাকশনে যেতে দেখছি না। তাদের কঠোর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি। একজন কমিশনারকে বলতে শুনেছি রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি, তারাই ব্যবস্থা নেবে। বিষয়টি এমন নয়। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইসি এক অভিন্ন সত্তা। আচরণবিধি লংঘন হলে ইসি ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা- উভয় দিক থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
আচরণবিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশংকা করছেন সাবেক আরেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, আচরণবিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে ইসিকে কঠোর হতে দেখছি না। আচরণবিধি প্রতিপালনে ইসিকে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আইন প্রয়োগ করতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
তফসিল ঘোষণার পর থেকে কমিশন থেকে আচরণবিধি লংঘনের দায়ে কারও বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। শোকজ ও জরিমানাসহ যেটুকু হয়েছে তার সবটাই করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও মেজিস্ট্রেটরা। অবশ্য বুধবার নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, যেকোনো পদমর্যাদার লোকই হোক না কেন আচরণবিধি লংঘন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রতি আমাদের নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করবে না এমন কাজে সরকারের সংশ্লিষ্টদের বাধা দেব না। তবে প্রভাব বিস্তার করে এমন কাজ করতে দেয়া হবে না। করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী ও বিভিন্ন পদে যারা রয়েছেন তারা বিভিন্ন কাজে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারেন। আচরণবিধিতে রয়েছে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারি সুবিধাভোগী কোনো প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। যদি করেন তবে তারা আইনবিরোধী কাজ করেছেন বলে গণ্য হবে। অবশ্যই আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আজম নাছির উদ্দিনের ‘নির্বাচনী কৌশল’ ঠিক করতে গত ৩১ মার্চ পেনিনসুলা হোটেলে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবেং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর। ওই ঘটনায় তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আচরণবিধির লংঘনের অভিযোগ ওঠে। আচরণবিধির ধারা ১৪-তে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ এবং সরকারের কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা তাদের সমপদমর্যাদা সম্পন্ন সরকারি সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি নির্বাচন-পূর্ব সময়ে নির্বাচনী প্রচারণায় বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
ওই ঘটনা তদন্ত করে চট্টগ্রাম রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কমিশনে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেনিনসুলা হোটেলের বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর কোনো মন্তব্য করেননি। তবে, বৈঠকে উপস্থিত সাবেক সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী বলেন, আমরা পরামর্শ সভা করেছি। বৈঠকটি ছিল রুদ্ধদ্বার। সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকে সংশ্লিষ্টরা ভোটারদের কাছে বারবার প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান। তবে মন্ত্রী বৈঠকে প্রকাশ্যে কোনো ভোট প্রার্থনা করেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ঘটনা সম্পর্কে রিটার্নিং কর্মকর্তা ইসিতে পাঠানো চিঠিতে বলেন, মন্ত্রী মহোদয় প্রকাশ্যে কোনো নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেননি এবং মেয়র প্রার্থী আজম নাছির ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণে বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই ঘটনায় রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেন কমিশনের নির্দেশনা চেয়ে চিঠি দেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার চিঠি এবং তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি লংঘিত হয়নি বলে বুধবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামের রিটার্নিং কর্মকর্তাকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে। এই চিঠির খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ওই বিষয়টি নির্বাচনী প্রচারণার কোনো সংজ্ঞার মধ্যে পড়েনি। তথাপি পুরো বিধিমালাটি পাঠে নির্বাচনী প্রচারণার যে ধরন পরিলক্ষিত হয়েছে, তাতে মনে হয় এটা ছিল কৌশল নির্ধারণসংক্রান্ত বৈঠক- যা নির্বাচনী বিধি লংঘনের মধ্যে পড়ে না। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের আইন শাখা একটি মতামত দেয়। এই মতামতে বলা হয়, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বিষয়টি নির্বাচনী প্রচারণার কোনো সংজ্ঞায় পড়েনি। তাই সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে বলে প্রতীয়মান হয় না। অতএব বিষয়টি চট্টগ্রাম রিটার্নিং অফিসার এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে অবহিত করা যেতে পারে।
এর আগে বুধবার দুপুরে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন সরাসরি আচরণবিধি লংঘন করেননি বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেনের পাঠানো চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামের মন্ত্রীদের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো বৈঠক করেনি। চট্টগ্রামের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিজে তদন্ত করে একটি রিপোর্ট দিয়েছেন। ওই রিপোর্টে তিনি বলেছেন, বৈঠকে মন্ত্রীদের অংশগ্রহণের এমন অভিযোগ পত্রিকায় এসেছে। তারা সেটি তদন্ত করে দেখেছেন যে, মন্ত্রী সেখান ছিলেন। তবে নির্বাচনী কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি। সেহেতু রিটার্নিং অফিসার নিজেই জানিয়েছেন (মন্ত্রীর) কোনো সরাসরি আচরণবিধি লংঘন হয়নি।
এর আগে প্রচারণা শুরুর দিন মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের প্রবেশ মুখ থেকে জনসংযোগ শুরু করেন মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন। ওই সময়ে সড়ক বন্ধ করে প্রচারণা চালানোর অভিযোগ ওঠে এ মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে। মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন রঙ্গিন পোস্টার বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন বেশ কয়েকজন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী। বিধি অনুযায়ী, পাঁচজনের বেশি লোক নিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধান নেই। ওইসব ঘটনায় শোকজ ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ইসি। এছাড়া নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর আগেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছবিসহ পোস্টার সাঁটিয়ে আগাম প্রচারণা চালান বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিলেও পোস্টার সরিয়ে নেননি অনেক প্রার্থী। ইসির নির্দেশনা অমান্যকারী এসব প্রার্থীর বিরুদ্ধেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
এদিকে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাস্তায় নামার সুযোগ দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। বুধবার সেগুন বাগিচায় শিল্পকলা একাডেমিতে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, খালেদা জিয়া সিটি নির্বাচনে প্রচারণায় নামবেন বলে শুনছি। কিন্তু কোন মুখে নামবেন? বাংলার মানুষ এত বোকা না। আমার ভাই মরেছে। জামায়াত-বিএনপি খুনি। খালেদা জিয়া খুনি। এই খুনিদের রাস্তায় নামার সুযোগ দেয়া হবে না। নৌমন্ত্রীর এ বক্তব্য আচরণবিধির লংঘন কিনা জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বিরক্তি প্রকাশ করে সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘এটা কোনো প্রশ্ন হল’।

No comments

Powered by Blogger.