পছন্দের প্রার্থী দিতে মন্ত্রী-এমপিদের দৌড়ঝাঁপ by উৎপল রায়

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাইয়ে যে কোন মূল্যে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও দল অন্তঃপ্রাণ প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার কথা বলেছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা। কিন্তু তাদের এ পরিকল্পনায় বাদ সেধেছেন মন্ত্রী-এমপিরা। রাজধানীর অধিকাংশ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাইয়ে স্বজনপ্রীতি, অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে অযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের সমর্থন দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর এতে করে নির্বাচনের অগেই মহানগর, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। ক্ষোভের দানা বাঁধছে তাদের মনে। ফলে কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের জয়ী হওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন মহানগরের অনেক শীর্ষ নেতা। আর এ অবস্থার জন্য তারা দায়ী করছেন প্রার্থী বাছাইয়ে দায়িত্বপালনকারী ঢাকার কয়েকজন সংসদ সদস্য ও বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন মন্ত্রীকে। নেতাদের দাবি প্রার্থী বাছাইয়ে মূল কাজের বাইরে নিজেদের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মন্ত্রী-এমপিরা এ বিষয়ে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করেছেন। নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের বাছাই করে তার তালিকা করেছেন। এমনকি দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ও সৎ অনেক প্রার্থীকে হুমকি দিয়ে তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতেও বাধ্য করেছেন। ফলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের যে পরিকল্পনা দলের হাইকমান্ডের ছিল তা আর সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নেতারা অভিযোগ করেন, প্রার্থী বাছাইয়ে তাদের কোন সুপারিশ বা মতামতকে প্রাধান্যই দেয়া হয়নি। এবিষয়ে তাদের একপ্রকার কোণঠাসা ও অন্ধকারে রেখেই মন্ত্রী-এমপিরা তাদের মনমতো প্রার্থী বাছাই করেছেন। কিন্তু মুখ খুললে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আসতে পারে এ কারণে তারা চুপ করে আছেন। তারা আরও জানান, উত্তর ও দক্ষিণের বিভিন্ন সংসদীয় এলাকার সংসদ সদস্য ও মহানগরের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা নিজেদের পছন্দমতো কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাই করে তালিকা প্রস্তুত করেছেন। এতে অপরিচিত ও অযোগ্য প্রার্থী উড়ে এসে জুড়ে বসে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছেন। মহানগরের রাজনীতিতে এসব প্রার্থীর কোন অবদান নেই। এছাড়া কোন কোন ওয়ার্ডে সন্ত্রাসী ও দলের নাম ভাঙ্গিয়ে অপকর্ম করা প্রার্থীরাও কাউন্সিলর প্রার্থী পদে নির্বাচনের জন্য মন্ত্রী-এমপিদের তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কঠিন হবে। আর ভবিষ্যতে দলের জন্যও তা হবে অশনিসংকেত। এ অবস্থায় দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তর ও দক্ষিণে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও  ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য সাহারা খাতুন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও ঢাকা-১১ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতউল্লাহ, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ঢাকা-১৫ আসনের সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক ও ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম তাদের নিজ নিজ প্রার্থীদের বিষয়ে তালিকা প্রস্তুত করেছেন। মহানগরের নেতাদের দৃষ্টিতে তালিকায় থাকা প্রার্থীদের অনেকেই অযোগ্য। দলেও তাদের তেমন অবদান নেই। আবার এ মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই চাপ প্রয়োগ করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে একক প্রার্থিতা নিশ্চিত করার অজুহাতে অনেক যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করিয়েছেন। এবিষয়ে নগর আওয়ামী লীগের একজন সহসভাপতি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ঢাকার রাজনীতির চাকা ধরে রাখার জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। অনেকটা সফলও হয়েছি। যে কারণে বিএনপি রাজধানীতে খুব একটা সফল হতে পারেনি। তাই সিটি করপোরেশন নির্বাচন আগামী দিনের রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে যোগ্য, গ্রহণযোগ্য এবং দলের জন্য যিনি কাজ করবেন সে ধরনের অনেক প্রার্থীর বিষয়ে সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণের একাধিক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা আমাদের মতামতকে কোন গুরুত্বই দেননি। ফলে যা হবার তাই হবে। নির্বাচনে নিজেদের সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী করে আনা কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন,  এ অবস্থায় মহানগরের বিভিন্ন থানা ওয়ার্ডের নেতা কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। যে কারণে তারা সিটি নির্বাচনে তেমনভাবে সক্রিয় হচ্ছেন না। তাছাড়া এ ধরনের কার্যক্রমে নির্বাচনে দলের গ্রুপিং ও কোন্দল বাড়বে। বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যাও বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে নির্বাচনে। তাই নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীদের বিজয়ী করে আনতে বেগ পেতে হতে পারে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজ মানবজমিনকে বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা একজন প্রার্থীর জন্য সমর্থন বা সুপারিশ করতেই পারেন। এ বিষয়ে তারা কাজও করছেন। তবে কে মন্ত্রী এমপির লোক এটা আমরা বুঝিনা। আমরা চাই গ্রহণযোগ্য ও যোগ্য প্রার্থী। এবিষয়ে দলের সভানেত্রীরও নির্দেশনা রয়েছে। যে দলের জন্য কাজ করবে, এলাকায় গ্রহণযোগ্য তাদেরকেই আমরা নির্বাচন করছি। তিনি বলেন, কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাইয়ের তালিকা আমরা অনেকটাই গুছিয়ে এনেছি। দু-একদিনের মধ্যেই তা দলের শীর্ষ পর্যায়ে হস্তান্তর করা হবে। আমরা যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করার চেষ্টা করেছি। এবিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুকুল চৌধুরী বলেন, যদি সত্যিই মন্ত্রী-এমপিরা প্রার্থী বাছাইয়ে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে অযোগ্য লোকদের তালিকা করে থাকেন তাহলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। এতে করে অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়তে পারে। নির্বাচনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া তৃণমূলে দলে গ্রুপিং ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে দলের রাজনীতিতে। তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধরে রেখেছেন থানা ওয়ার্ডের ত্যাগী নেতারা। এর মধ্যে মহানগরের অনেক শীর্ষ নেতাও রয়েছেন। তাই আমরা চাই দল অন্তঃপ্রাণ, কর্মীবান্ধব, গ্রহণযোগ্য ও মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবে এমন প্রার্থীরাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক। কিন্তু লবিং-তদবিরে অযোগ্য প্রার্থীরা যদি নির্বাচনে আসে সেটি দলের জন্য খুব একটা শুভকর হবে না। এ বিষয়ে আলাপকালে মহানগরের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, যদি এভাবেই প্রার্থী নির্ধারণ হয় তাহলে অনেক ত্যাগী ও যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়তে পারে। তাই এবিষয়ে দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের এখনই উদ্যাগ নেয়া উচিত। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ বলেন, শুনেছি দু-একজন মন্ত্রী-এমপি কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাইয়ে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করেছেন। তবে মনে হয় না তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন। কারণ, দলীয় সভানেত্রী প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় তৎপর আছেন। এজন্য তার নিজস্ব লোকজনও কাজ করছে। আশা করি যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীরাই কাউন্সিলর নির্বাচনে সুযোগ পাবেন।

No comments

Powered by Blogger.