ব্যাগপাড়ার নারীরা by জাহিদ সুমন

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ছোট কুপট গ্রামটিকে এখন সবাই ব্যাগপাড়া বলেই চেনে। সাংসারিক কাজের ফাঁকে সবাই ব্যস্ত শপিং ব্যাগ তৈরিতে। রাতারাতি বদলে গেছে গ্রামটির চিত্র। দারিদ্র্যকে পিছনে ফেলে ব্যাগপাড়ার নারীরা এখন নতুন স্বপ্নে বিভোর।
যেভাবে শুরু: সুন্দরবন উপকূলীয় এ জনপদটির অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের জীবিকা নির্বাহের উৎস হচ্ছে- শ্রম বিক্রি করা, চিংড়িঘেরে মাছ ধরা, সুন্দরবনে কাঠ, গোলপাতা, মধু সংগ্রহ, মাছ ও কাঁকড়া ধরা। দিন এনে দিন খাওয়া এভাবেই তাদের সংসার চলে। তাদের সময় কাটে ঠিকই কিন্তু সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালের ২৫শে মে সর্বনাশা জলোচ্ছ্বাস আইলায় মানুষের আশা-ভরসা সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। লবণাক্ততা এই এলাকায় প্রধান শত্রু। গ্রামের আবাদি জমিতে লবণ-পানি প্রবেশ করায় হারিয়ে গেছে কৃষি বৈচিত্র্য। সৃষ্টি হয় বেকারত্ব। বাড়ির পুরুষরা কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে শহরে। গ্রামের নারীরা যারা ঘর থেকে বাইরে বের হতো না তারা সন্তানদের মুখে আহার তুলে দিতে কাজের সন্ধানে ছুটতে থাকে। এ সময়ে দিশাহারা মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তনে সহযোগিতার হাত বাড়ায় বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থা। সুশীলন নামক এ সংস্থাটি তাদের জীবনযাত্রা বদলে ফেলতে সহযোগিতা করে। সিমেন্টের খালি ব্যাগ থেকে শপিং ব্যাগ তৈরি করার কৌশল শেখায় স্থানীয় এক যুবক আমিনুর। ছোট কুপট গ্রামের মালীপাড়ার আমিনুর রহমান এ অঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ নিয়ে আসে। দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামটির নারীরা কোমর বেঁধে শপিং ব্যাগ তৈরির কাজে নেমে পড়েন।
ব্যাগপাড়ার ব্যস্ত নারীরা: শ্যামনগরের আটুলিয়া ইউনিয়নের ছোট কুপট গ্রাম বর্তমানে ব্যাগপাড়া নামে পরিচিত। গ্রামের নারীরা জানতে পারে সিমেন্টের ব্যাগের তৈরি শপিং ব্যাগের স্থানীয় বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে ভালই চাহিদা আছে। তারা সিদ্ধান্ত নিলো সংসারে কাজের ফাঁকে ঘরে বসে শপিং ব্যাগ তৈরি করবে। সিদ্ধান্ত নিলো তৈরি ব্যাগ স্বামীরা বাজারে গিয়ে দোকানে দোকানে বিক্রি করবে। তাদের আর ঘর থেকে বাইরে যেতে হবে না। সুশীলন ওই গ্রামের মানুষের বিকল্প জীবিকায়নের জন্য গ্রামের মানুষদের নিয়ে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। উৎপাদক দল তৈরি করে। বাজার বিশ্লেষণ করে বাজার সম্প্রসারণ কর্মপরিকল্পনা তৈরি এবং বাজার-যাচাই করে শপিং ব্যাগ তৈরি এবং বাজারজাতকরণমূলক কাজ সম্পর্কে নারীরা কিভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।
শপিং ব্যাগে স্বপ্ন: ব্যাগপাড়ার একজন নারী সংসারের সকল কাজের পাশাপাশি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০০টি শপিং ব্যাগ বানাতে পারেন। এই শপিং ব্যাগগুলো বানাতে তাদের খরচ হয় ৫০টি বস্তা যার মূল্য ২৫০ টাকা, ৫০ টাকার সুতা+মেশিন খরচসহ অন্যান্য ৫০ টাকা মোট ৩৫০ টাকা। আর বাজারে বিক্রি হয় ৬০০ টাকা। নিট লাভ ২৫০ টাকা। শ্যামনগরসহ আশপাশের বেশক’টি এলাকায় ব্যাগপাড়ার পুরুষরা নারীদের তৈরি ব্যাগ নিয়ে বিক্রি করছেন। যে বাজারে বেশি দাম পান সেখানেই ব্যাগ বিক্রি করেন। ব্যাগপাড়ার ৩৭ জন নারীর বদলে যাওয়া জীবন দেখতে ভিড় জমাচ্ছে শ্যামনগরের অজোপাড়াগাঁ ব্যাগপাড়ায়।
ব্যাগপাড়ার নারী প্রধান মাকসুদা খাতুন বলেন, লবণ-পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনে সুখ ফিরিয়ে এনেছি। কখনও ভাবিনি আজকের মতো এমন দিন আসবে। অতীতকে আর স্মরণ করতে চাই না। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি। বদলে যাওয়া নারীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নকারী সংগঠন সুশীলনের রি-কল প্রকল্পের প্রোগ্রাম ফ্যাসিলিটেটর রুখসানা পারভীন বলেন, ব্যাগপাড়ার নারীরা আজ দেশের মডেলে পরিণত হয়েছেন। এ গ্রামের নারীরা ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যকে জয় করেছেন। সুশীলন তাদেরকে পরিচর্যা করেছে মাত্র।

No comments

Powered by Blogger.