হাওরজুড়ে ধানের হাসি by সুমনকুমার দাশ

হাওরে ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক। সিলেট সদর উপজেলার বাদাঘাট
নীলগাঁও হাওর থেকে গত সোমবার তোলা ছবি l আনিস মাহমুদ
‘বউ উঠানে নাই—প’ড়ে আছে একখানা ঢেঁকি—ধান কে কুটবে বলো; কত দিন সে তো আর কোটে নাকো ধান’
এভাবেই আফসোস করেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তবে হাওরাঞ্চলের চিত্র এখন ঠিক তার উল্টো। বাড়ির পুরুষেরা খেতে বোরো ধান কাটছেন আর সেই ধান রোদে শুকোতে-তুলতে দিন যাচ্ছে কিষানিদের। অসম্ভব ব্যস্ত তাঁরা সবাই। হাওরজুড়ে চলছে ধান কাটার মহোৎসব।
সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও নেত্রকোনা জেলাজুড়েই রয়েছে বড় বড় হাওর। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের একমাত্র ফসল বোরো ধান। সচরাচর বৈশাখ মাসে বোরো ফসল কেটে ঘরে তোলার কাজ চলে। কিন্তু এবার কিছুটা আগেই ধান পেকেছে। ধানের হলুদ ছড়ায় ভরে গেছে খেত। তাই এই চৈত্রের শেষে কিষান-কিষানিদের ব্যস্ততার যেন শেষ নেই।
সাতসকালে ঘুম থেকে জেগে কিছু মুখে দিয়েই কামলা (দিনমজুর) নিয়ে কৃষকেরা কাস্তে হাতে খেতে যাচ্ছেন। এরপর কেউ উদাসী কণ্ঠে গান গাইতে গাইতে আবার কেউ খোশগল্প করে কাটছেন ধান। দুপুরে বাড়ির বউ-ঝিরা পরম মমতায় পাত্র ভরে মাঠে নিয়ে যাচ্ছেন প্রিয় মানুষটির জন্য খাবার। হিজল-করচগাছের নিচে ছায়ায় বসে জিরিয়ে কৃষকেরা মুখে তুলছেন সে খাবার। সামান্য বিরতির পর আবারও ধান কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন কৃষক।
বৃহত্তর সিলেট ইতিহাস প্রণয়ন পরিষদের সভাপতি আবদুল আজিজ জানান, হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটার মৌসুমকে ঘিরে উৎসবের শেষ নেই। দিনভর পরিশ্রম করে ক্লান্ত-শ্রান্ত কিষান-কিষানিরা রাতে বাউলগান, যাত্রাগানসহ নানা লোকগানের আসর বসান। এভাবে বিনোদনের মাধ্যমে তাঁরা মানসিক প্রশান্তি লাভ করেন। এরপর মধ্যরাতে ঘুমাতে যান এবং ভোরে জেগে উঠে আবার ফসল তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
নীলগাঁও গ্রামের পাশের একটি খলায় (ধান শুকানোর মাঠ) ধান শুকাচ্ছিলেন গৃহিণী আমেনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘বৈশাখ আসার আগেই বৈশাখী কামকাজ শুরু অই গেছে। সকাল থাকি ধান মাড়াইয়ের পর শুকানোর কাম শুরু হয়।’
সরেজমিনে সিলেটের কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখা গেছে, ধান পেকে হলুদ ছড়া নুয়ে পড়েছে। মৃদু বাতাসে দুলছে সেই ছড়া। কোনো কোনো হাওরে আবার ধান কেবল পাকতে শুরু করেছে। দিন দশেক বাদে সে ধান কাটার উপযোগী হবে।
সিলেট সদর উপজেলার বাদাঘাট নীলগাঁও হাওরে ধান কাটছিলেন কৃষক আবদুল কাদির (৪৮)। তিনি জানান, চলতি বছর তিনি ১২ একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। সাত-আট দিন আগে তাঁর অধিকাংশ জমির ধান পেকেছে। গতবারের মতো এবারও ফলন ভালো হয়েছে। দুই দিন আগে থেকে ধান কাটতে শুরু করেছেন। ফসল ঘরে তোলার পর নতুন চালের পিঠা বানানো হবে। সে সময় আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করে একসঙ্গে ধান তোলার উৎসব হবে।
আবদুল কাদিরের ভাষ্যে উৎসবের যে বয়ান পাওয়া যায়, সেটা হাওরে খুব ঘটা করে পালিত হয়। ধান তোলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে জ্যৈষ্ঠ মাস। তখন আম-কাঁঠালের সঙ্গে সদ্য তোলা ধান দিয়ে তৈরি নতুন চালে তৈরি করা হয় নানা ধরনের পিঠা-পায়েস। বাড়িতে বাড়িতে চলে নানা গানের আয়োজন। সে এক অন্য রকম হাওর, অন্য রকম উৎসব। সেই উৎসবের আগাম ভাবনার পাশাপাশি এখন ধান কাটায় বুঁদ হয়ে রয়েছেন হাওরাঞ্চলের মানুষ।
অবশ্য এর উল্টো চিত্রও রয়েছে। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা অঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় কয়েক দিন আগে ভারী শিলাবৃষ্টিতে বিনষ্ট হয়ে গেছে খেতের ফসল। একমাত্র বোরো ফসল হারিয়ে সেসব এলাকায় চলছে কৃষকদের আহাজারি।

No comments

Powered by Blogger.