সিটি নির্বাচনে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের আশঙ্কা by নুরুজ্জামান লাবু

আসন্ন সিটি নির্বাচনে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা ও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা। এ কারণে বৈধ অস্ত্রধারীদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এমনকি নির্বাচনের সাত দিন আগে সকল বৈধ অস্ত্র নিজ নিজ থানায় জমা দেয়ার নির্দেশও দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৬ সহস্রাধিক বৈধ অস্ত্র ও সোয়া লক্ষাধিক গুলি বরাদ্দ দেয়া রয়েছে। এসব অস্ত্র-গুলি ব্যবহারে এগিয়ে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে বৈধ অস্ত্র দিয়ে সিটি নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের হুমকি-ধমকি দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বৈধ অস্ত্রধারীদের নজরদারি করা হচ্ছে। সিটি নির্বাচন নিয়ে কেউ যেন বৈধ অস্ত্রের অপব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে নির্বাচন কমিশন অথবা ডিএমপি কমিশনারের পক্ষ থেকে সকল বৈধ অস্ত্রব্যবহারকারীদের অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের পক্ষে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হতে পারে। ঘটতে পারে প্রাাণহানিসহ নানা দুর্ঘটনা। এ কারণে সিটি নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি বৈধ অস্ত্র জমা নেয়া হবে। তবে ক্ষমতাসীন দল সুবিধা নেয়ার উদ্দেশ্যে দশম জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারও বৈধ অস্ত্র জমা নাও নিতে পারে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, বর্তমান সময়ে ব্যবসায়ী ও ভিআইপি ব্যক্তি ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য ছোটবড় রাজনৈতিক নেতাকর্মী বিশেষ কৌশলে অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন। এদের অনেকেই কোমরে অস্ত্র ঝুলিয়ে চলাফেরা করেন। এমনকি বৈধ অস্ত্র দিয়ে হুমকি-ধমকি দেয়ারও বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় নেতাকর্মীদের অস্ত্র নিয়ে ঢোকার চেষ্টার ঘটনাও ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের চাইতে আওয়ামী লীগের ছয় বছরে দিগুণ অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সাধারণত রাষ্ট্রদ্রোহী কিংবা আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত নয়, এমন নাগরিকেরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ট্যাক্স পরিশোধ করলে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়। এর পরেও মন্ত্রী বা এমপিদের সুপারিশের ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়। এমন অনেকেই বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন, যাদের অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার কোনও যোগ্যতা নেই। এমনকি সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরাও লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশ নিয়ে তারা অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন। একারণে এসব অস্ত্রের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৈধ অনেক অস্ত্রের গুলির হিসাব থাকে। এছাড়া গুলি খরচ করা হলে সেই গুলির হিসাব দিতে হয়। কিন্তু অসাধু অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা বেশি দামে গুলি কেনে অপরাধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া লাইন্সেকৃত অস্ত্রের গুলির সঙ্গে মিলিয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা বিশেষ উপায়ে অবৈধ গুলি সরবরাহ করে থাকে। অনেক বৈধ অস্ত্রধারীরা গোপনে এসব গুলিও ব্যবহার করে থাকে। এসব গুলি দিয়ে বৈধ অস্ত্র ভাড়া দেয়ার নজিরও রয়েছে। র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা এমন অনেক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে যাদের হাতে লাইসেন্সকৃত অস্ত্র ছিল। পরে সেসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করার সুপারিশও করা হয়েছে। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আর বৈধ অস্ত্র যাতে কেউ অপব্যবহার করতে না পারে এজন্য গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে যেভাবে নির্দেশনা দেয়া হবে সেভাবেই কাজ করবে র‌্যাব।
ডিএমপি সূত্র জানায়, পুলিশের খাতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৬ হাজার ১৯৫টি। এসব অস্ত্রের বিপরীতে গুলি বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৬৩১টি। এসবের মধ্যে ঢাকার ৮টি ক্রাইম জোনে লাইসেন্সধারী পিস্তলের সংখ্যা ১ হাজার ২৪৭টি, এর বিপরীতে গুলি বরাদ্দ রয়েছে ২৭ হাজার ২৫৬টি। রিভলভার রয়েছে ১ হাজার ২৭টি, রিভলভারের বিপরীতে গুলি বরাদ্দ রয়েছে ১৫ হাজার ৮৭৫টি। রাইফেল রয়েছে ৬৯৩টি, এর বিপরীতে গুলি বরাদ্দ রয়েছে ৪৩ হাজার ২৬৫টি। লাইসেন্সকৃত শটগানের সংখ্যা ৭৭৩টি, এর বিপরীতে গুলি বরাদ্দ রয়েছে ১৮ হাজার ৬৩১টি। একনলা বন্দুকের সংখ্যা ১ হাজার ৩৮৮টি, এর বিপরীতে গুলি বরাদ্দ রয়েছে ১৬ হাজার ২৬০টি। দোনলা বন্দুকের সংখ্যা ১ হাজার ৬২টি, এর বিপরীতে বরাদ্দকৃত গুলির সংখ্যা ১৬ হাজার ৩৪৪টি। এছাড়া ৫টি এয়ারগান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে শতাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীর বৈধ অস্ত্র রয়েছে। তেজগাঁও এলাকার সরকার সমর্থিত একজন কাউন্সিলর প্রার্থী এবং তার অনুসারীদের একাধিক বৈধ অস্ত্র রয়েছে। বৈধ অস্ত্র অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে প্রভাবিত করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমান আইন অনুযায়ী কোনোও অস্ত্রের লাইসেন্সধারী এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গেলে সংশ্লিষ্ট থানায় রিপোর্ট করার বিধান রয়েছে। এই বিধান কেউ মানেন না। এছাড়া প্রতিটি থানায় মনিটরিং করতে থানার সেকেন্ড অফিসারের কাছে একটি রেজিস্টার খাতা থাকার কথা। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মাসে দুবার ওই পুলিশ কর্মকর্তা তার এলাকার তালিকাভুক্ত লাইসেন্সকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিদর্শন করবেন। পরিদর্শন শেষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অস্ত্রের লাইসেন্সে স্বাক্ষর করে থানায় জিডি করার পর পার্সোনাল ডায়েরিতে স্বাক্ষর করবেন। মনিটরিংয়ের কঠোর এ বিধান থাকলেও পুলিশ এবং অস্ত্রধারী কেউ মানেন না।

No comments

Powered by Blogger.