‘আমরা রাজনীতির শিকার’ by মানসুরা হোসাইন

ট্রাকের শ্রমিক ফারুক কটনবার্ড দিয়ে নিজের হাত পরিষ্কার করছেন।
পাশে তাঁর স্ত্রী বসে আছেন। ছবি সাবিনা ইয়াসমিন
খালেদা জিয়া তো জামিনে ছাড়া পাইছে, বাসায় চইল্যা গেছে, আর আমরা অন্ধকারে। হাসিনা ক্ষমতা টিকাইয়্যা রাখার জন্য তাঁর জায়গাতেই আছে। খালি আমরা সাধারণ মানুষ পুইড়া মরতাছি। সাধারণ মানুষের দেশে থাকার কি অধিকার নাই? সাধারণ মানুষের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থাকব? একমাত্র ছেলেরে মানুষ করার স্বপ্ন দেখছিলাম। এখন নিজে আবার উইঠা দাঁড়াতে পারমু কি না, তারই ঠিক নাই।’
আজ বুধবার দুপুরে খেদ ঝেড়ে এসব কথা বলেন ট্রাকমালিক ইকবাল হোসেন। গত ৫ মার্চ গভীর রাতে ট্রাকে লাকড়ি নিয়ে ভালুকা থেকে মানিকগঞ্জে যাচ্ছিলেন ইকবাল হোসেন। রাত সাড়ে তিনটার দিকে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন তিনি। দুদিন আগে ইকবালের অস্ত্রোপচার হয়েছে। পা থেকে মাংস নিয়ে হাতে লাগানো হয়েছে। আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পঞ্চম তলায় ইকবাল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। কথা হয় হরতাল-অবরোধে দগ্ধ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। ইকবাল হোসেনের মতো অন্যদের কণ্ঠেও ক্ষোভ আর হতাশা। তাঁরা নিজেদের এ পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না।
ইকবালের এক ছেলে। বয়স মাত্র নয় বছর। পড়াশোনায় ভালো। তাই ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। কিন্তু সে গুড়ে এখন বালি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা তো কিছুই পাইলাম না। ট্রাকটার বয়স মাত্র আট মাস। ৪১ লাখ টাকা দিয়ে কিনছিলাম। ৬০ কিস্তির মধ্যে মাত্র আট কিস্তি দিছি। আর সেই ট্রাক চোখের সামনে ছাই হইয়া গেল!’
ইকবাল বলেন, ‘কানে এখন প্রচণ্ড ব্যথা। ইনজেকশন দিয়া ব্যথা কমাইতে হয়। ডান হাতের আঙুল সোজা করতে পারি না। এই হাত ঠিক না হইলে তো সবই শেষ।’
সুমন মিয়া (১৭) ইকবাল হোসেনের ট্রাকের সহকারী। সুমন ওই সময় ঘুমাচ্ছিল। তারও একই অবস্থা। সুমনের বাবা শওকত হোসেন গাছ থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে এখন অচল। কাজ করতে পারেন না। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে পড়াশোনা করছে। সুমনই ছিল পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। ৫ মার্চ বার্ন ইউনিটে ভর্তির পর ৬০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে সুমন।
ছেলের এ পরিণতিতে শওকত বলেন, ‘আমরা যদি রাজনীতি করার পাইতাম, তাইলে তো শাহেনশাহের মতন চলতে পারতাম। আমরা সাধারণ নিরীহ মানুষ। ছেলের এই অবস্থার লাইগ্যা রাগ কইরা আর কারে কী কমু? কইলেই কেডা শুনব? ’
মো. খোকন গুলিস্তানের চপ্পল ব্যবসায়ী। গত ২৩ জানুয়ারি পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন তিনি। এক চোখে এখন দেখতে পান না। বাম হাত পেটের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। নাভি ও নাভির চারপাশে গর্ত হয়ে গেছে। সেখান থেকে দূষিত রক্ত ঝরছে। অস্ত্রোপচারের পর আজ ২১ দিন পর প্রথম বসতে চেষ্টা করেন। তবে তখনই রক্ত পড়া শুরু হয়। আবার শুতে চান খোকন। তীব্র ব্যথায় আর শুতে পারছিলেন না। খোকনের দুই আত্মীয় চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে পাশের রোগীর এক স্বজনকে ডাকেন। তারপর তাঁকে শোয়ানো সম্ভব হয়।
খোকন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন।
ট্রাকের শ্রমিক আরব আলী গত ২২ মার্চ পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন। তাঁর সঙ্গে ট্রাকে ছিলেন আরও নয়জন। এর মধ্যে আরব আলীর পরিবারেরই ছিলেন চারজন। ঘটনার পর পাঁচজন মারা গেছেন। আরব আলীর চাচা ও এক চাচাতো ভাইও মারা গেছেন।
আরব আলী বলেন, ‘হাত দিয়া কাজ করতাম। এখন হাতের যে অবস্থা হইছে, তা দিয়া আর কাজ করতে পারুম না। এখন সরকার যদি কিছু কইরা দেয়।’
চাঁদপুরে পেট্রলবোমায় দগ্ধ ট্রাকের সহকারী রুবেল হোসেন বিয়ে করেননি। বাবা ট্রাকচালক ছিলেন। অসুস্থতার জন্য এখন আর ট্রাক চালাতে পারেন না। রুবেল কাজ করে বোনের বিয়ে দিয়েছেন। এক ভাই ফারুককে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। এখন রুবেলের হাত, মুখ, দুই পাসহ প্রায় পুরো শরীরই পুড়ে গেছে।
রুবেলের ভাই ফারুক বলেন, ‘আমরা রাজনীতির শিকার। রাজনীতির তো একটা নিয়ম আছে। সাধারণ মানুষ মাইরা তো রাজনীতি হইতে পারে না। যারা রাজনীতি করে, তারা তো ভালো আছে। আমরা তো ভালো নাই। আমাদের পাশে তো কেউ দাঁড়াইল না। আমার পড়াশোনা বন্ধ হইয়া গেছে। আমার ভাইয়ের ভবিষ্যৎ কে করে দেবে? জীবিকার জন্য বের হইতেই হয়। পথে বের হওয়া কি অপরাধ?’
রুবেলের মা ফরিদা বেগম ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘আমার তিন ছেলেমেয়েই মূল সম্পদ। আমার যে সম্পদ সংসার চালাইত, সে এখন মরতে বসছে। আমার সংসার পানিতে পইড়া গেছে। চোখের সামনে ছেলের কষ্ট আর সহ্য হয় না।’
তিন ছেলেমেয়ের জনক ট্রাকের শ্রমিক ফারুক জানালেন, তাঁর তিন ছেলেমেয়েই পড়াশোনা করে। তবে এখন লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। ২৩ মার্চ ঘটনার পর থেকে ফারুক ও তাঁর স্ত্রী হাসপাতালে, ছেলেমেয়েরা বাড়িতে।
ফারুক বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না। যারা আমার এই অবস্থা করছে, তারা দেখতাছে আমার অবস্থা। এখন ভাত কিনা যে খামু, তারও অবস্থা নাই। এই পর্যন্ত অনুদান পাইছি ২০ হাজার টাকা। মেয়েরা বাড়ি থেইক্যা ফোন কইরা কান্দে। তারা কয়, আব্বা আমরা কী খামু?’
কথাগুলো বলতে বলতে ফারুকের চোখ দিয়ে পানি পড়ে। তাঁর স্ত্রী পরম মমতায় তা মুছে দেন।
বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শংকর পাল জানালেন, হরতাল-অবরোধে দগ্ধ হয়ে এ পর্যন্ত বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছে ১৮১ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ২২ জন। এখন পর্যন্ত ভর্তি আছে ২১ জন। একবার চিকিৎ​সা নিয়ে বাড়ি ফেরার পর তিনজন আবার ভর্তি হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.