প্রবৃদ্ধি ৭% করাই বড় চ্যালেঞ্জ -বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতিসহ কয়েকটি গবেষণা সংস্থার সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর আলোচনা

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত
রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলই থাকছে। তার পরও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার আটকে রয়েছে ৬ শতাংশের ঘরে। এই হারকে ৭ শতাংশে উন্নীত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জিডিপি-বিনিয়োগ হার বাড়ানো জরুরি।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে গতকাল রোববার কয়েকটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রাক্-বাজেট আলোচনায় বক্তারা এমন অভিমত তুলে ধরেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের চার বিভাগের চার সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা আগামী বাজেট নিয়ে গবেষকদের আলোচনা ও পরামর্শ শোনেন। এ সময় কিছু কিছু প্রশ্নের জবাবও দেন অর্থমন্ত্রী।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির হার প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্জিত হচ্ছে না। যদিও এই হার গড়ে ১ শতাংশ কম অর্জন অতটা দোষের কিছু না। কিন্তু একই জায়গায় আটকে রয়েছি আমরা। ৬ থেকে ৭-এ ঢোকাটাই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ এখন।’
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরও বলেন, ‘যতই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকুক না কেন, কোনো কিছুতেই সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় চিড় ধরে না। মুশকিল হচ্ছে প্রবৃদ্ধির হার অর্জনে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আমরা বের হতে পারছি না। অথচ ভারত সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীল হওয়া সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধির হার ৩, ৫, ৬ থেকে এখন সাড়ে ৮-এর দিকে যাচ্ছে।’
সুদের হার ব্যাংকের বিষয়: গোটা বিশ্বেই বাংলাদেশের ঋণের সুদের হার বেশি বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ব্যাংক মালিকদের উচ্চ মুনাফা প্রবণতা এ জন্য দায়ী। লাইসেন্স পেয়েই তাঁরা মনে করছেন পেয়ে গেলাম নিশ্চিত মুনাফা অর্জনের পথ।
বিদেশের ব্যাংক থেকে ৪-৫ শতাংশ সুদে ঋণ নেওয়ার সুযোগ আরও বাড়ালে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, সুদের হারও কমবে বলে তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সুদের হার আমরা নির্ধারণ করি না, ব্যাংকই করে। আর যাঁরা ব্যাংকের মালিক, তাঁরা আবার বিনিয়োগকারীও। শুধু সুদের হার নয়, অযৌক্তিকভাবে আমানতের সুদও এ দেশে বেশি।’
সরকারি প্রতিষ্ঠান বেআইনিভাবে ব্যাংকে টাকা রাখে বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এখন থেকে যিনি রাখবেন, তাঁকে জেলে যেতে হবে। যাতে জীবনে কেউ চিন্তাও না করতে পারেন। এটা সম্পূর্ণভাবে আর্থিক বিশৃঙ্খলা।’
ঋণ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ব্যাংকঋণ ব্যবস্থাপনায় সরকারের বড় দুর্বলতা হচ্ছে দেশের ৭০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা ২ শতাংশ ঋণ পায়। আর ৯৮ শতাংশ ঋণ পায় ৩০ শতাংশ লোক। আবার ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতাদের বেশি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
আহসান মনসুর বলেন, ৬১টি পরিবারকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ৭৭ হাজার কোটি টাকা, যা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে গেছে। এ বিষয়টিকে গভীর নজরজারির মধ্যে আনা জরুরি।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ৯৬ শতাংশ ঋণ গেছে ৪ শতাংশ লোকের কাছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা যায় কীভাবে—এটা তাঁরও প্রশ্ন।
বেসরকারি খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক: সোনালী ব্যাংক রেখে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করা, রাজধানীতে দ্বিতল বাস চালু, বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া শিশুদের নিয়ে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ, অবকাঠামো প্রকল্প দ্রুততর করা, টিআইএনধারীদের কাছ থেকে কর আদায়ে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থার পরামর্শ দেন তিনি।
চাহিদা বাড়ছে না শেয়ারবাজারে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন বলেন, শেয়ারবাজারে প্রতিবছরই ১০-১৫টি করে কোম্পানি আসছে। এতে বাজারে সরবরাহ বাড়লেও চাহিদা বাড়ছে না। বাজারধসের শুরুর দিন ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর লেনদেন ছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা, আর সেদিন হলো ২২৮ কোটি টাকা। অথচ ওই সময়ে বাজার মূলধন যা ছিল, এখনো প্রায় তাই।
ব্যাংক খাত নিয়ে একরকম নজরদারি থাকলেও শেয়ারবাজার নিয়ে তা নেই উল্লেখ করে হেলালউদ্দিন বলেন, ‘এই বাজারে যে এখনো লুটপাট হচ্ছে, তা আমরা দেখছি না।’ শেয়ারবাজার নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কিছু করণীয় রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
অন্যান্য পরামর্শ: বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কাজী সাহাবুদ্দিন খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষির বহুমুখীকরণের পরামর্শ দেন। অর্থনীতি সমিতির সহসভাপতি এ এফ মুজতাহিদ প্রশ্ন তোলেন প্রকল্পের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়া নিয়ে।
আশরাফউদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাজধানীর ৩০ শতাংশ মানুষের পায়ে হেঁটে চলার পথ (ফুটপাত) হাইজ্যাক হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন আহমেদ প্রবাসী-আয়ের (রেমিট্যান্স) যথাযথ ব্যবহারে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দেন।
বিআইডিএসের গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, বাজেটে নারীদের জন্য ১০০ কোটি টাকা রাখলেও কোন খাতে ব্যয় হবে এই টাকা—সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই বছর চলে যায়। বেসরকারি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন ও ইন্টারনেটের চার্জ কমানোর পরামর্শ দেন তিনি।
সবশেষে অর্থমন্ত্রী ধারণা দেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার তিন লাখ কোটি টাকার মতো হবে।

No comments

Powered by Blogger.