ঝড়ে লন্ডভন্ড জনপদ- মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৬

বগুড়ার পালপাড়ায় শনিবার সন্ধ্যায় কালবৈশাখীর আঘাতে
লন্ডভন্ড হয়ে গেছে থাকার ঘর। সেই ঘরের ধ্বংসস্তূপের ভেতর
থেকে বইপত্র সরিয়ে নিচ্ছে এক শিক্ষার্থী l ছবি: ফোকাস বাংলা
দেশের বিভিন্ন স্থানে গত শনিবার সন্ধ্যায় আঘাত হানা প্রচণ্ড ঝড়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৬ জনে দাঁড়িয়েছে। কেবল বগুড়াতে মারা গেছেন ২০ জন। অন্যদের মধ্যে ঢাকায় দুজন, রাজশাহীতে পাঁচজন, সিরাজগঞ্জে দুজন এবং পাবনা, জামালপুর, নওগাঁ, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা, নরসিংদী ও কুষ্টিয়ায় একজন করে মারা যান। এ ছাড়া ঝড়ে আহত হয়েছেন দুই শতাধিক ব্যক্তি। নৌকাডুবির একাধিক ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত পাঁচজন। মূলত দেয়ালধসে, ঘর ও গাছচাপা পড়ে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, বজ্রপাতে ও নৌকাডুবিতে হতাহেতর ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানি ছাড়াও প্রায় ৩৬ হাজার কাঁচা ও আধা পাকা বাড়ি, স্কুল, দোকান সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। উপড়ে গেছে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও অসংখ্য গাছপালা। কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
ঝড়ের এক দিন পরও গতকাল বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল অনেক এলাকা। বসতবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে প্রচণ্ড কষ্টে দিন কাটাচ্ছে বহু মানুষ। তবে দুর্গত লোকজনের সহায়তায় সরকারিভাবে এগিয়ে আসার তেমন লক্ষণ দেখা যায়নি।
বগুড়ায় নিহত ২০: ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা। রাতের আঁধারে ধ্বংসযজ্ঞের ভয়বহতা তেমন বোঝা না গেলেও গতকাল সকাল হতেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিস্মিত, হতবাক হয়ে যান শহরবাসী। শহরজুড়ে কেবল ধ্বংসের চিহ্ন।
এদিকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও অন্যান্য সূত্রে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে ২০ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানা গেছে। ঝড়ে আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। আহত ব্যক্তিদের অধিকাংশকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পরিচয় নিশ্চিত হওয়া মৃত ব্যক্তিরা হলেন বগুড়া শহরের বউবাজার এসপি সেতুসংলগ্ন বস্তি এলাকার আজিরন বিবি, একই বস্তির আড়াই মাসের শিশু নীলা খাতুন, শহরদীঘি এলাকার রজব আলী, মধ্য পালশা এলাকার পলাশ, সদর উপজেলার চানপুর গ্রামের গোলাপী বেগম, পালশা গ্রামের মোস্তাফিজার রহমান, গোকুল গ্রামের আকালু, শাজাহানপুরের ক্ষুদ্র ফুলকোর্ট গ্রামের আবদুল মান্নান, ঘাসিরা গ্রামের বৃদ্ধা রাবেয়া বেগম, খোয়ারপাড়া গ্রামের পায়েল, সারিয়াকান্দির বিলপাড়ান গ্রামের শান্তা বেগম, ফুলবাড়ী পূর্বপাড়া গ্রামের সুজন মিয়া, ধারাবর্ষা চরের নৌকাযাত্রী মোজাম হোসেন ও ফুলবাড়ী মালোপাড়ার সুবল চন্দ্র, কাহালুর হারলতা গ্রামের আজিজুল ইসলাম ও ইসমাইল হোসেন, ধুনটের জোড়শিমুল গ্রামের আফজাল হোসেন, সোনাতলার লোহাগড়া গ্রামের ফিরোজা বেগম, গাবতলীর তেলিহাটা ফকিরপাড়া গ্রামের সামিরা বেগম এবং নন্দীগ্রামের বৈলগ্রামের আবদুস সাত্তার। আবদুস সাত্তার নন্দীগ্রাম উপজেলা জাকের পার্টির সভাপতি।
শনিবার ঝড়ের পর থেকেই বিপর্যস্ত শহরের বিদ্যুৎব্যবস্থা। বিদ্যুৎ না থাকায় শহরজুড়ে পানিরও হাহাকার। বন্ধ রয়েছে পৌরসভার পানি সরবরাহ। অচল হয়ে পড়েছে টেলিফোন যোগাযোগ। চার্জ দিতে না পারায় অনেকের মুঠোফোনও বন্ধ হয়ে গেছে। জেলা পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রশিদ বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে কত দিন সময় লাগবে, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. খোরশেদ আলম জানান, ঝড়ে ৯২ হাজার পরিবারের ৪ লাখ ১৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২৮ হাজার ৬৬৭টি বাড়িঘর সম্পূর্ণ ও ৭০ হাজার বাড়িঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে ২৬টি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ১৪৭টি গোবাদিপশুও মারা গেছে।
অন্যান্য স্থানের চিত্র: নওগাঁর মান্দা উপজেলায় শাহানাজ বেগম নামের এক গৃহবধূ দেয়ালচাপায় মারা গেছেন। আহত হয়েছেন নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ প্রায় অর্ধশত লোক। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ জনকে মান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি, কয়েক হাজার গাছপালা। ফসলের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে ব্যাপক। জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
নরসিংদীর সদর উপজেলার চাকশাল এলাকায় আলাল উদ্দিন নামের এক তরুণ শনিবার রাতে মারা গেছেন। বাড়ির পাশে মাছ ধরতে গিয়ে গায়ের ওপর গাছের ডাল ভেঙে পড়ে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।
সিরাজগঞ্জে নৌকাডুবি ও বজ্রপাতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা হলেন কাজীপুরের পীরগাছা গ্রামের মোজাম্মেল হক ও উল্লাপাড়ার দুর্গাপুর গ্রামের ফজলার রহমান। মোজাম্মেল মারা যান নৌকাডুবিতে। এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন একই গ্রামের আবদুল খালেক।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বনগ্রাম গ্রামে ঘরচাপায় সন্ধ্যা বেগম নামের এক বৃদ্ধা মারা গেছেন। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জেলা সদর ও শিবালয়ের কয়েকটি স্থানে গাছ পড়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। জেলায় বেশ কিছু কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক শ বিঘা জমির ভুট্টা, গম ও বোরো ধানের।
পাবনা শহরের চাঁদমারী এলাকায় শনিবার রাতে দোকানের ওপর গাছ উপড়ে মারা গেছেন জামের উদ্দিন (৮০) নামের এক চা-বিক্রেতা। তাঁর বাড়ি পৌর সদরের চক গোবিন্দা মহল্লায়। ঝড়ে সুজানগর উপজেলায় পেঁয়াজখেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জামালপুরের ইসলামপুরে যমুনা নদীর কুলকান্দি হার্ট পয়েন্টে শনিবার রাতে নৌকাডুবিতে জহুরা বেগম নামের এক নারী মারা গেছেন। তিনি বরুল গ্রামের মৃত ছাত্তার মুন্সির স্ত্রী। একই ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন কুলকান্দি এলাকার ব্যাপারী পাড়ার মঙ্গল আলী, মৌল্লা ব্যাপারী ও রশিদুল।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বাঁধবাজার এলাকায় বজ্রপাতে আতাউল ইসলাম নামের এক পল্লি চিকিৎসক মারা গেছেন। তিনি সান্দিয়া গ্রামের বাসিন্দা। ঝড়ে পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে ফসলের। বিধ্বস্ত হয়েছে শত শত গাছ। কুষ্টিয়া-হরিপুর বাঁশসেতু আংশিক ভেঙে গিয়ে গড়াই নদ পারাপারে সমস্যা হচ্ছে।
গাইবান্ধায় ঝড়ে যমুনা নদীতে নৌকাডুবিতে সাঘাটা উপজেলার নলছিয়া গ্রামের আমিনুল ইসলামের স্ত্রী সাহেরা খাতুন মারা গেছেন। এ ছাড়া পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত এবং বহু গাছপালা উপড়ে গেছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২৩ ঘণ্টা জেলা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। এদিকে গতকাল দুপুরে ঝড়ের সময় বজ্রপাতে বিভিন্ন স্থানে ছয়জন ইটভাটাশ্রমিক আহত হয়েছেন।
জামালপুরে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে প্রায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি ও ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় ৩০ জন। উপড়ে গেছে শত শত গাছ। ২০ ঘণ্টা পর জামালপুর শহরে বিদ্যুৎ এলেও জেলার অন্যত্র তা বন্ধ রয়েছে।
ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম বলেন, ইউনিয়নের শতকরা ৯০ ভাগ বাড়িঘর লন্ডভন্ড হয়েছে। শত শত পরিবার খোলা আকাশের নিচে রয়েছে। তাদের দ্রুত সহায়তা প্রয়োজন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুমুর রহমান বলেন, ঝড়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ উপজেলা।
রাজশাহীর বাঘার পীরগাছা গ্রামে রাস্তার ওপর উপড়ে পড়া একটি বটগাছ গতকালও সরানো সম্ভব হয়নি। রাজশাহীজুড়েই শনিবারের ঝড়ে এভাবে পুরোনো গাছপালা ভেঙে পড়েছে। ফসলের ক্ষতি হয়েছে, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। গতকাল ফুলমনি নামের এক আদিবাসী নারী মারা গেছেন। তাঁর বাড়ি পুঠিয়ার ভরতমাড়িয়া গ্রামে। তাঁকে নিয়ে জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচজন।
জেলা প্রশাসনের হিসাবমতে, ঝড়ে ২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বসতবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ হাজার ২৩৩টি। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৬ হাজার ৯৬৭টি বসতবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭৬টি।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে সহস্রাধিক কাঁচা বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখায় দুই ঘাটের মহাসড়কে আটকা পড়ে কয়েক শ যানবাহন।
শেরপুরে ঝড়ে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শতাধিক ঘরবাড়ি ও বিপুলসংখ্যক গাছপালা বিধ্বস্ত হয়েছে। উঠতি বোরো ফসল ও সবজি আবাদেরও ক্ষতি হয়েছে। শেরপুর-জামালপুর ৩৩ কেভি সঞ্চালন লাইনে গাছ উপড়ে পড়ে পুরো জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল ভোররাতে জেলা সদরে আংশিক বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার পাঁচটি গ্রাম ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে। দুটি মন্দিরসহ দুই শতাধিক বাড়িঘর হয়েছে বিধ্বস্ত। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন। অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়া ছাড়াও সুপারিবাগান, রবিশস্য ও বোরো খেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শতাধিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঞ্ছারামপুর উপজেলার কড়িকান্দি ঘাটের পন্টুন ঝড়ে ভেসে গিয়ে গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত ২০ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। এতে বাঞ্ছারামপুর-আড়াইহাজার রুটে কয়েক শ গাড়ি আটকা পড়লে যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন।
নাটোরে অর্ধশতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার হেক্টর জমির উঠতি বোরো, গম, ভুট্টা, খেসারি এবং লিচু, আম, কলাবাগান ও সবজি খেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
মৌলভীবাজার শহর গতকাল সকাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন ছিল। এতে বাসাবাড়িতে পানি-সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া জেলার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে অস্ত্রোপচারসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অনেকটা সময় বন্ধ রাখতে হয়েছে।
এ ছাড়া ঝড়ে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় গতকাল সকাল পর্যন্ত প্রায় ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। গাছ উপড়ে পড়ে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বলিঘর হুজুরী শাহ উচ্চবিদ্যালয় টিনের ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা}

No comments

Powered by Blogger.