তংশা নামের প্রজাপতি by আ ন ম আমিনুর রহমান

পুরুষ তংশা প্রজাপতি। ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের
কমলগঞ্জের আদমপুর বিট থেকে ছবিটি তোলা l লেখক
স্ত্রী তংশা প্রজাপতি। ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর বান্দরবানের
জাদির পাহাড় থেকে ছবিটি তোলা
পাহাড়ি জেলা বান্দরবানের একটি আকর্ষণীয় স্থানের নাম ‘বুদ্ধধাতু জাদি’ বা ‘স্বর্ণমন্দির’। বান্দরবান শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে জাদির পাহাড়ের ওপরে এর অবস্থান। ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো স্বর্ণমন্দির পরিদর্শনে যাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএস (কৃষি) চূড়ান্ত পর্বের ছাত্রদের সঙ্গে, দেশ ভ্রমণের অংশ হিসেবে। তবে দুর্ভাগ্য, সেদিন কোনো কারণে মন্দিরটি বন্ধ থাকায় আমরা ভেতরে যেতে পারিনি। কিন্তু এসেই যখন পড়েছি, পাহাড়ের চূড়ায় না উঠে তো যাওয়া যাবে না। তাই উৎসাহী কয়েকজনকে নিয়ে জাদির পাহাড়ের ওপরে উঠে গেলাম। ওখান থেকে বান্দরবান শহর ও আশপাশের এলাকায় একটা চমৎকার ‘বার্ডস আই ভিউ’ পেলাম।
পাহাড়ের ওপরের ঘাসবনটাও চমৎকার। ওখানে ফুটে আছে অসংখ্য বাহারি রঙের নাম না-জানা ছোট-বড় বুনো ফুল। ওখানেই দেখা হলো রং-বেরঙের একঝাঁক খুদে বন্ধুর সঙ্গে। এক যাত্রায় এত বাহারি বন্ধুর দেখা পাব ভাবতেও পারিনি। কাজেই ওদের ক্যামেরাবন্দী করার সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। পাহাড় থেকে নামার সময় হঠাৎই মাটিতে বসা এক বন্ধুর দিকে নজর গেল। আরে, এ তো দেখছি সামনে-পেছনে দুদিকেই মাথা! নাকি দুদিকেই লেজ? বড়ই আশ্চর্যের বিষয়! দেরি না করে কয়েকটা ক্লিক করলাম। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় এসে বইপত্র ঘেঁটে ওর পরিচয় বের করলাম। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার আদমপুর বিটের গহিন অরণ্যের ছড়ার পাশে ওকে আমি আবার দেখলাম।
এই খুদে বন্ধু হলো এ দেশের অনিন্দ্য সুন্দর এক প্রজাপতি—তংশা (Common Tit)। Lycaenidae (লাইসিনিডি) পরিবারের সদস্য তংশার বৈজ্ঞানিক নাম Hypolycaena erylus (হাইপোলাইসিনা ইরাইলাস)।
তংশা ছোট আকারের প্রজাপতি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন দেহের সামনে ও পেছনে দুদিকেই দুটি লেজ আছে। তাই এরা দুই লেজওয়ালা প্রজাপতি হিসেবেও পরিচিত। আবার এমনও মনে হতে পারে যে দেহের সামনে-পেছনে দুদিকেই মাথা আছে। কাজেই অনেকের কাছে এরা দুই মাথাওয়ালা প্রজাপতি বলেও মনে হতে পারে। আসলে শত্রুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থা।
তংশা প্রজাপতির পুরুষ ও স্ত্রীর চেহারায় ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের ডানা ও দেহের ওপরের দিকে গাঢ় নীল। তার ওপর রয়েছে চকচকে বেগুনি আভা। সামনের ডানায় দুটি গোলাকার দাগ। পেছনের ডানার নিচের দিকে দুটি করে চোখ আছে। স্ত্রীর ডানা ও দেহের ওপরের দিকের রং বাদামি। পেছনের ডানার নিচের প্রান্তে দুটি চোখ। চোখগুলো পুরুষের থেকেও স্পষ্ট এবং ওপরের চোখে সোনালি ফোঁটা।
এরা চিরসবুজ, আধা চিরসবুজ ও পাতাঝরা বনের বাসিন্দা। বনের এক চিলতে আর্দ্র বা স্যাঁতসেঁতে জায়গা বেশি পছন্দ। এ দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন বনে এদের দেখা মেলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের ১ হাজার ৩০০ মিটার উঁচুতেও দেখা যায়। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আনাগোনা বেশি।
স্ত্রী প্রজাপতি উপযুক্ত গাছের পাতা ও কচি ডগায় ডিম পাড়ে। এক জায়গায় সাধারণত একটি করে ডিম পাড়ে। ডিমের আকার গম্বুজের মতো এবং রং সাদা। ডিম ফুটে শুককীট বের হতে মাত্র তিন দিন সময় লাগে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশে তংশার দেখা মেলে।

No comments

Powered by Blogger.