তামাশা by মাহবুব তালুকদার

চাচা বললেন, বিএনপির কাণ্ডটা দেখ। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে বিএনপি বলছে, এটা নাকি তামাশার নির্বাচন। তাই যদি হবে তাহলে তোমরা নির্বাচনে এলে কেনো?
আমি জানালাম, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতার বদল চায়। এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন তামাশার কিনা জানি না। তবে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটাই তামাশার ব্যাপার।
চাচা রক্তচক্ষু তুলে তাকালেন আমার দিকে, তুমি কি বিএনপিতে নাম লিখিয়েছ?
চাচা! এই এক অদ্ভুত সমস্যা আমাদের। আমরা আমাদের চিন্তার বিপরীত বক্তব্যকে মোটেই সহ্য করতে পারি না। এটা মোটেই গণতান্ত্রিক মানসিকতা নয়।
হু! এই বয়সে এসে তোমার কাছ থেকে গণতন্ত্রের সবক নিতে হচ্ছে। ঠিক আছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া তামাশা কেন, সেটা ব্যাখ্যা কর।
আমি বললাম, প্রথমত, সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে বলা হচ্ছে নির্দলীয় নির্বাচন। এটা ডাহা মিথ্যা কথা। নির্দলীয় যদি হবে তবে আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে অংশগ্রহণের জন্য এত তোষামোদ করছেন কেন?
তারপর?
একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের সদস্যপদ ত্যাগ করে এই নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। হতে পারে তিনি একটি দলের সদস্য। কিন্তু তিনি ঐ দলের সংসদ সদস্য নন। সুতরাং তিনি সংসদ সদস্য থাকবেন কি থাকবেন না, এটা দলীয় প্রধানের বিষয় হতে পারে না। তাছাড়া একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পদত্যাগ করতে চাইলে তাকে বাধা দেয়া হবে কেন? সংসদ সদস্য পদে পদত্যাগ করে মেয়র পদে নির্বাচন করায় বিধি-বিধান ভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা নেই। তাই হাজী সেলিমকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া আমার কাছে তামাশা মনে হয়।
তারপর?
গতবার ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হয়। অতঃপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার দীর্ঘ ছুটিতে আমেরিকা পাড়ি জমান। এবারও ভয় হচ্ছে, নির্বাচনকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয় বিদেশে চলে যাবেন কিনা! সেদিন টিভিতে দেখলাম, শত নাগরিক কমিটির ৬ জন প্রতিনিধি সিইসি’র সঙ্গে দেখা করার পর তিনি বলেছেন, যারা আত্মগোপনে আছে তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমার নয়। খুবই সত্য কথা। কিন্তু আত্মগোপনকারীদের খুঁজে বের করার দাবি তার কাছে কে করতে গেছেন? তাকে বলা হয়েছিল, বিরোধী দলের প্রার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালাতে পারেন ও ভোট দিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করার জন্য। মূল বিষয়ের পাশ কাটিয়ে যাওয়া কি একরকম তামাশা নয়?
তারপর?
এখন পর্যন্ত যা আলামত দেখা যাচ্ছে তাতে নির্বাচন কমিশন সংবিধানে প্রদত্ত এবং তাদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। স্পষ্টত: ক্ষমতাসীন দলের বিষয়ে তারা পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে বললে অত্যুক্তি বলা হবে না। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে এক সভায় তাদের কয়েকজন শীর্ষ মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন, যেখানে মেয়র প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। এটা নির্বাচন বিধির বরখেলাপ বলা হলেও নির্বাচন কমিশন কোন ব্যবস্থা না নিয়ে চুপ করে আছে। মনে হয় এটা ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী তামাশা।
চাচা এতক্ষণ ধৈর্য সহকারে শুনছিলেন। মনে মনে তার ধৈর্যের প্রশংসা করলাম আমি। চাচা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি আর কিছু বলার আছে?
আছে। আরও অনেক কথা বলার আছে।
আজ তোমার কথা এ পর্যন্তই থাক। এবার আমি বলি।
বলুন।
তুমি কি চাও দেশটা জঙ্গি ও খুনিদের হাতে চলে যাক?
না। অবশ্যই না।
তাহলে এত অভিযোগ করছো কেন? কি চাও তুমি?
চাচা! আমি চাই আমাদের এই সুন্দর দেশটায় কেউ যেন কৌশলে ক্ষমতায় না যায় কিংবা জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে না থাকে। সবার অংশগ্রহণে এখানে সুন্দর ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন হতে হবে। ভয়-ভীতিহীন নির্বাচনে সবাই যেন ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল আমার কাম্য, আজ্ঞাবহ বিরোধী দল নয়।
এসবই সম্ভব যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে। কিন্তু তুমি আসল কথাটাই বললে না।
কী আসল কথা?
জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি! আমাদের এখন দরকার জনগণের আর্থিক সচ্ছলতা, জিডিপি’র হার বাড়ানো। এসব চাও না?
নিশ্চয়ই চাই।
তাহলে তোমার আর কিছু বলার নেই। ২০১৯ সাল পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেশটা চালাতে দাও। দেখতে পাবে বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? তারপর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ ৫টি উন্নত দেশের তালিকায় উঠে যাবে।
মানে?
৫টি দেশ হলো আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশ। আমরা তখন বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ হয়ে যাব।
চাচা! আমরা তো তা দেখে যেতে পারব না।
কেন পারব না?
আমরা কি ততদিন বেঁচে থাকব?
অবশ্যই বেঁচে থাকব। আওয়ামী লীগের আমলে মানুষের গড় আয়ু কত বেড়ে গেছে জানো? আগামীতে আমাদের দেশের মানুষ একশ’ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবে। সুতরাং আমরা সবই দেখে যেতে পারব। আওয়ামী লীগ তো ২০৪১ পর্যন্ত তাদের সব পরিকল্পনা সাজিয়ে নিয়েছে। এতে জনগণের কিছু স্যাক্রিফাইস দরকার।
কী স্যাক্রিফাইস?
জনগণের উচিত নির্বাচন নিয়ে তর্কবিতর্ক না করে আওয়ামী লীগের হাতকে শক্তিশালী করা। আমাদের এখন একদফা। ‘আওয়ামী লীগের হাত শক্তিশালী কর, সোনার বাংলাকে উঁচিয়ে ধর।’
তাহলে গণতন্ত্র? বিব্রতকণ্ঠে আমি প্রশ্ন করলাম।
গণতন্ত্রের অর্থ কি? তুমি যদি পশ্চিমা ধরনের গণতন্ত্রের কথা বলো, তাহলে বলবো, ওটা আমাদের দেশে অচল। পশ্চিমের দিকে না তাকিয়ে আমাদের এখন পূর্বদিকে তাকাতে হবে।
পূর্ব দিক মানে?
মানে প্রতিবেশী মিয়ানমার, চীন, সিঙ্গাপুর-এদের দিকে। এদের দেশে কি গণতন্ত্র নেই? অবশ্যই আছে। আমরা গণতন্ত্রের বস্তাপচা পশ্চিমা ধারণাকে পালটে দিতে চাই। গণতন্ত্রের নতুন ধারণা বা কনসেপ্ট হচ্ছে, আগে উন্নয়ন ও পরে গণতন্ত্র।
চাচা! আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এখন তাহলে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের কি হবে?
সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন? নির্বাচন হবে নির্বাচনের মতোই। ওটা পুলিশের হাতে ছেড়ে দাও। সত্যি বলতে কি, আমাদের দেশের পুলিশ কর্মকর্তারা মূলত দার্শনিক।
পুলিশ কর্মকর্তারা দার্শনিক?
কথাটা শুনে তুমি আঁতকে উঠলে যে! আসলে আমি বলতে চাচ্ছি তারা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। ভবিষ্যৎ নির্বাচনের কথা চিন্তা করে তারা নাশকতার মামলাগুলো সাজিয়ে রেখেছিলেন। বিরোধী দলের প্রার্থীরা তাতে নামে-বেনামে আসামি।
নামে না হয় বুঝলাম। বেনামে মানে?
মানে, বেনামীরা সবাই পুলিশের ‘অজ্ঞাতনামা’ তালিকায় আছে। নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে চাইলে তাদের কোন অনুমতি লাগবে না। অবশ্য পুলিশও ঠিকমতো আসামি প্রার্থীদের ভয় দেখাতে গ্রেপ্তার করার হুমকি দিয়ে চলেছে। বিরোধী দলের প্রার্থীরা যাতে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্যে বা রাস্তায় না আসতে পারে সে জন্য পুলিশ তৎপর। যারা নাশকতা করে তাদের ভোট চাওয়ার ও ভোট দেয়ার কোন অধিকার নেই।
চাচা! পত্রিকায় দেখলাম, মাননীয় মন্ত্রীরা নির্বাচনের আচরণবিধি মোটেই মানছেন না। তারা রীতিমত ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।
তোমার কথা মোটেই সত্য নয়। মন্ত্রীরা ঘরের ভেতর বসে সভা করছেন এবং তারা জনগণকে প্রকাশ্যে ভোট দেয়ার আহ্বান জানাননি।
কিন্তু চাচা! চট্টগ্রামে একজন পূর্ণমন্ত্রী বলেছেন, ‘যে করেই হোক আমাদের জিততে হবে। জিততে হবে এ জন্য যে, ১৫০ জন পেট্রোলবোমায় নিহত হয়েছেন। যদি পরাজিত হই তাহলে পেট্রোলবোমার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।’
এতে তুমি দোষের কি দেখলে, তা বুঝতে পারলাম না।
‘যে কোন প্রকারে হোক জিততে হবে’-মন্ত্রী মহোদয়ের একথায় নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে।
কে বললো তোমাকে? চাচা মৃদু হেসে বললেন, প্রবাদ আছে ‘যুদ্ধ আর প্রেমে কোন নীতি-নৈতিকতার স্থান নেই।’ ভোটযুদ্ধ তো আসলে যুদ্ধই।
আমি বললাম এসব করে আওয়ামী লীগ জিততে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন হারবে। নির্বাচন কমিশনের ওপর এমনিতে মানুষের তেমন আস্থা নেই।
মানুষের আস্থা কি কমিশন ধুয়ে খাবে? ওদের ওপর সরকারের আস্থা থাকলেই হলো। নির্বাচনের পর সরকার দেশ-বিদেশে প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনের বৈধতা আনিয়ে দিলেই হলো।
চাচা! আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন এটা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এতে দেশ-বিদেশের বৈধতা যোগাড়ের প্রশ্ন নেই।
তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। এসব নিয়ে আসলে আমাদের চুপ করে থাকাই ভালো। সিটি করপোরেশনের মেয়র কে হলো না হলো, তাতে তোমার আর আমার কি আসে যায়? আমাদের কেবল দেখতে হবে দেশটা যেন স্বাধীনতা বিরোধীদের দখলে চলে না যায়।
স্বাভাবিক নির্বাচন হলে দেশ তো বিরোধীদের হাতে যেতেই পারে।
অ্যাবসার্ড। স্বাভাবিক নির্বাচনে যদি নাশকতাকারীদের জয় হয়, তাহলে সে নির্বাচন কেউ সাপোর্ট করতে পারে না।
এতে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াই কিন্তু তামাশায় পর্যবসিত হয়ে যাবে।
তামাশার কথা বলে আজ তুমি আমাকে অনেক কিছু শুনিয়েছো। তামাশা শব্দটা কি খারাপ? মোটেই খারাপ নয়। হাসিমুখে চাচা বললেন, আমাদের দেশের জনগণ তামাশা খুব পছন্দ করে। তারা সারাক্ষণ তামাশার মধ্যে থাকতে চায়। টেলিভিশনের টক শোতে ও পত্র-পত্রিকার কলামে তামাশা দেখতে ও পড়তে চায়। রাজনীতিবিদদের কাছে তারা তামাশা ছাড়া আর কিছু আশা করে না। রাজনীতিবিদরাও তাদের সঙ্গে তামাশা করতে ভালোবাসেন।

No comments

Powered by Blogger.