আদিবাসী নারী শ্রমনির্ভর কাজে বেশি by পার্থ শঙ্কর সাহা

রাজধানীর ফার্মগেটে একটি বিউটি পারলারের মালিক কুহেলি ক্যাটরিনা আজিম। মান্দি বা গারো এই নারী পাঁচ বছর আগে পারলারটি খোলেন। ২০০০ সাল থেকে বিউটি পারলারে কাজ করছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার এই আদিবাসী নারী। মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজে পরিবারের প্রধান ও সম্পদের মালিক নারী। এই সমাজের কুহেলি এতিমদের স্কুলে এসএসসি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জীবনের প্রয়োজন, একই সঙ্গে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছা—এই দুইয়ে মিলে পারলারে কাজ শুরু করলাম। দেখলাম, কোনো কাজ খারাপ না।’ এখন দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। তিনি জানান, এখন ঢাকায় ১২টি বিউটি পারলারের মালিক গারো নারীরা।
বিভিন্ন সূত্রমতে, রাজধানীতে বিউটি পারলারে কাজ করেন প্রায় পাঁচ হাজার গারো মেয়ে। দেশের নানা স্থানের পারলারেও গারো মেয়েরা আছেন। অন্য আদিবাসী নারীরাও আছেন পারলার, তৈরি পোশাকশিল্পসহ শ্রমনির্ভর বিভিন্ন পেশায়। তবে সরকারি চাকরি, বেসরকারি বড় পদ ও উদ্যোক্তা হিসেবে আদিবাসী নারীদের উপস্থিতি হাতে গোনা। আদিবাসী নেতারা বলছেন, এর কারণ শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা।
গারো ইনডিজিনাস মিচিক অ্যাসোসিয়েশনের করা ‘বিউটি পারলারে মান্দি মেয়েরা কেমন আছেন?’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বিউটি পারলারে কর্মরত গারো মেয়েদের ৫০ শতাংশের বেশি টাঙ্গাইলের মধুপুর বনের বাসিন্দা। আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘একসময় অনন্যোপায় হয়েই গারো মেয়েরা রাজধানীর পথে পা বাড়িয়েছিলেন। তাঁরা আজ নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছেন।’
ঢাকায় বিদেশি দূতাবাস, বিদেশি নাগরিকদের গৃহকর্মী, নার্সিং পেশায়ও গারো নারীরা কাজ করছেন। পোশাকশিল্পে কর্মরত আদিবাসী নারীদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা সম্পর্কে সরকারি বা বেসরকারিভাবে গ্রহণযোগ্য তথ্য নেই।
আদিবাসীদের সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে পোশাকশিল্পে আদিবাসী কর্মীর সংখ্যা অন্তত ২০ হাজার, যাঁদের ৬৫ শতাংশই নারী। তাঁরা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের। সাভার ইপিজেডে পাহাড়ি আদিবাসীর সংখ্যা বেশি হলেও সমতলের মান্দি, সাঁওতাল, ওঁরাও কর্মীরাও আছেন। সাভার ইপিজেড এলাকায় আদিবাসী কর্মীর সংখ্যা ১৫ হাজারের কম নয়, যাঁদের ৭০ শতাংশই নারী। তাঁদের একজন তাপসী চাকমা। বাড়ি রাঙামাটির শুভলং উপজেলার শিলছড়ি গ্রামে। এসএসসি পাস করে তিনি বছর পাঁচেক আগে পোশাকশিল্পে যোগ দেন। বললেন, ‘যদি এলাকায় কাজের সুযোগ থাকত, তাহলে হয়তো এত দূরে আসতাম না। তবে এসে খারাপও হয়নি।’
তবে বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীরা এখনো বেশ পিছিয়ে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৫২ হাজার ২৬৯ জন নারী চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। বাংলাদেশের যে চারটি জেলার মানুষ সবচেয়ে কম বিদেশ যায়, তার মধ্যে আছে বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও শেরপুর। রাঙামাটির নারী সংগঠন সিমওয়ান্তির পরিচালক টুকু তালুকদার বলেন, ‘নিরাপত্তাহীনতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অভাবই আদিবাসী নারীদের বিদেশে কম যাওয়ার কারণ।’
সরকারি ও বেসরকারি বড় চাকরিতে আদিবাসী নারী এখনো হাতে গোনা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি জাতিসত্তার মধ্যে বম, লুসাই, পাংখো, খিয়াং, খুমি, মুরং, ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর কোনো নারী বিসিএস কর্মকর্তা নেই। সমতলের বৃহত্তম আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সাঁওতালদের তিনজন নারী বিসিএস কর্মকর্তা। কোনো নারী বিসিএস কর্মকর্তা নেই সমতলের মুন্ডা, মাহালি, পাহাড়িয়া, মাহাতো জাতিগোষ্ঠীরও।
পার্বত্য তিন জেলায় তিনটি আদালতে পাঁচজন পাহাড়ি নারী আইনজীবী আছেন। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে দুজন করে। আর বান্দরবানে একজন। রাঙামাটির আইনজীবী সুস্মিতা চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইন পেশায় পাহাড়ি নারীরা এলেন পার্বত্য চুক্তির পর। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এই পেশায় আরও নারী আসবেন।’
শিল্পের উদ্যোক্তা হিসেবে পাহাড়ি নারীদের সোনালি অতীত থাকলেও এখন তা ফিকে। মঞ্জুলিকা চাকমা ১৯৬৫ সালে পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান বেইন টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে রাঙামাটিতে ২০টির মতো পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে। বেইন বাদে বাকি সবই বাঙালি মালিকানায়। মঞ্জুলিকা চাকমা বলেন, ‘উদ্যোক্তা হিসেবে আদিবাসী নারীদের দাঁড়ানোর পথে প্রধান অন্তরায় পুঁজির অভাব। ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা সুবিধা পান না তেমন।’
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন জানান, পার্বত্য তিন জেলা মিলিয়ে বেসরকারি সাহায্য সংস্থা বা এনজিওর সংখ্যা এখন ১৪০টি। এর মধ্যে নারীপ্রধান হিসেবে থাকা এনজিওর সংখ্যা ১৩টি। উত্তরাঞ্চল, যেখানে ১৬ লাখ আদিবাসীর বাস, সেখানে নারীপ্রধান হিসেবে আছে—এমন এনজিওর সংখ্যা দুটি।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান ‘চিটাগং হিল ট্রাক্টস ডেভেলপমেন্ট ফ্যাসিলিটি (সিএইচটিডিএফ)’ নামে দাতাদের উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট আদিবাসী কর্মীর ৭০ শতাংশই পুরুষ, নারী ৩০ শতাংশ। সিএইচটিডিএফের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ঝুমা দেওয়ান বলেন, ‘আদিবাসী নারীরা মাঠপর্যায়ে কাজ করলেও ব্যবস্থাপনা বা নীতিনির্ধারণে তাঁরা নেই। এর মূল কারণ, উচ্চশিক্ষিত আদিবাসী নারীর সংখ্যা কম। দারিদ্র্যই এর বড় কারণ।’
দারিদ্র্য ও শিক্ষার কম হারের পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতাকেও আদিবাসী নারীর পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে মনে করেন আদিবাসীদের মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারপারসন চৈতালী ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দূরে হওয়ার কারণে অনেকেই লেখাপড়া পড়া ছেড়ে দিয়েছে, পার্বত্যাঞ্চলে এমন ঘটনা আছে অনেক। স্কুলে যেতে নিগ্রহের ঘটনা এখনো ঘটছে।’

No comments

Powered by Blogger.