আসল সাকিব ডানা মেললেই তো...

এমনই ‘দল’ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ছবি: প্রথম আলো
২০০৬ সালের জুলাই-আগস্টে জিম্বাবুয়ে সফরে সাকিব আল হাসানের প্রতিভা প্রসঙ্গে কেউ একজন অধিনায়ক হাবিবুল বাশারকে জানালেন। প্রতিভা পরখ করতে সাকিবকে একটা প্রস্তুতি ম্যাচে খেলালেন অধিনায়ক। কিন্তু ওই ম্যাচে বলার মতো কিছু করতে পারেননি বলেই হয়তো সিরিজের প্রথম চার ওয়ানডেতে একাদশে ঠাঁই পেলেন না বাঁ-হাতি অলরাউন্ডার। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের সেই সিরিজে চতুর্থ ওয়ানডেতেই সিরিজ হেরে যাওয়ায় পঞ্চম ওয়ানডেতে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশের সামনে। এ কারণেই হয়তো ৬ আগস্ট, সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে নামিয়ে দেওয়া হলো সাকিবকে। প্রস্তুতি ম্যাচে বলার মতো না হলেও অভিষেক ওয়ানডেতে সাকিবের বোলিং দেখে হাবিবুল বুঝলেন ‘এ অন্য জিনিস’! হাবিবুলের ভাষায়, ‘সাকিব সেই খেলোয়াড় যে এক ভুল দ্বিতীয়বার না করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ’ বল হাতে সেদিন ১০ ওভারে ৩৯ রান দিয়ে নিলেন ১ উইকেট, ব্যাট হাতে অপরাজিত ৩০ রান। ম্যাচটা জিতলও বাংলাদেশ। এরপর সাকিব হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের আস্থার প্রতীক। পরিসংখ্যানও তা-ই বলে, এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলেছে ২৯৮ টি; এর মধ্যে জিতেছে ৮৮ টি। আর সাকিব খেলছেন এমন ম্যাচ জিতেছে ৬৪ টি। অর্থাৎ ৮৮.৯ শতাংশ জয় এসেছে সাকিব একাদশে থাকতেই।
আসলে জয়কে এভাবে তুলনা করা যায় না। হয়তো হাস্যকরও মনে হবে। কিন্তু অস্বীকার করতে পারবেন, সাকিব বাংলাদেশের নির্ভরতার প্রতীক নয়? শচীন টেন্ডুলকার যেমন ছিলেন ভারতের, ব্রায়ান লারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের, জ্যাক ক্যালিস দক্ষিণ আফ্রিকার। তবে এটা বলাই যায়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাকিব উল্লিখিত কিংবদন্তিদের চেয়েও বেশি নির্ভরতার প্রতীক।
কীভাবে? পরিসংখ্যানটা না হয় দেখুন। ভারত মোট ওয়ানডে জিতছে ৪৪২। টেন্ডুলকার খেলছে এমন ম্যাচে ভারতের জয় ২৩৪ টি। অর্থাৎ ভারতের ৫২.৯ শতাংশ জয় এসেছে টেন্ডুলকার একাদশে থাকতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ মোট ওয়ানডে জিতেছে ৩৭২ টি। লারা খেলেছেন এমন ম্যাচে জয় ১৩৮ টি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩৭ শতাংশ জয় এসেছে উইন্ডিজ কিংবদন্তি একাদশে থাকতে। অবশ্য ক্যারিবীয়দের সোনালি প্রজন্মের শেষদিকের প্রতিনিধি হওয়া লারার জেতার শতাংশ টেন্ডুলকারের তুলনায় কিছুটা কম। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে প্রোটিয়া কিংবদন্তি অলরাউন্ডার ক্যালিস। দক্ষিণ আফ্রিকা মোট ওয়ানডে জিতেছে ৩২৯ টি। ক্যালিস খেলেছেন এমন ম্যাচে জয় ২০৯ টি। প্রোটিয়াদের ৬৩.৫ শতাংশ জয়ের সাক্ষী ক্যালিস। আপনি বলুন, শতাংশের হিসাবে সবচেয়ে এগিয়ে কে?
ব্যাট হাতে না পারলে বল হাতে; বল হাতে না পারলে ব্যাট হাতে, কখনো বা দুই বিভাগেই-যেকোনোভাবেই হোক সাকিব নিজের ঝলক দেখাতে সব সময়ই দৃঢ়প্রত্যয়ী। সর্বশেষ, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি করলেও পরে ব্যাট হাতে তেমন জ্বলে উঠতে পারেননি। তবে বল হাতে ঠিকই পুষিয়ে দিয়েছিলেন সেটা। সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক ছিলেন তিনিই।
ভাবছেন, এ তো চেনাজানা গল্পটাই শোনানো হচ্ছে। কিন্তু এ বিশ্বকাপটা এ চেনা গল্পটাই অচেনারূপে ধরা দিচ্ছে। এখন আর বাংলাদেশ দল শুধু এক-দুজনের ওপর নির্ভরশীল নয়। এখন বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থেই একটা দল হয়ে উঠছে। টিম বাংলাদেশ। গতকালকের ম্যাচটা যেন এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কালকের ঐতিহাসিক জয়ে নায়কদের তালিকা করুন। মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক, রুবেল, মাশরাফি, তাসকিন। এমনকি সৌম্যকেও রাখতে হবে। আশ্চর্যজনক হলেও এ তালিকায় সাকিব নেই। এমনকি তামিমও। তবে তামিমের চেয়ে এক জায়গায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন সাকিব। ব্যাটিংয়ের ব্যর্থতা পুষিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে বোলিংয়ে। কিন্তু কাল ব্যাট হাতে ২ রান করে বল হাতে উইকেটশূন্য। অবশ্য উইকেট না পেলেও এদিন সাকিব ছিলেন বেশ মিতব্যয়ী। ১০ ওভারে ৪১ রান দিয়ে চাপে রেখে​ছিলেন ইংলিশদের। তারপরও ম্যাচের প্রত্যক্ষ নায়ক তাঁকে বলা যাবে না। 
সাকিব না পারলেই সব শেষ-এ ‘ধারণা’ থেকে বিশ্বকাপে দারুণভাবে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ। যেমন গতকালের ম্যাচের কথা ধরুন, সাকিবসহ ৯৯ রানে ৪ উইকেট পতনের পরও যেভাবে ইনিংসটাকে সাবলীলভাবে এগিয়ে নিলেন মুশফিকুর রহিম-মাহমুদউল্লাহ-এক কথায় দুর্দান্ত! এরপর প্রধান শক্তি স্পিন ছাপিয়ে পেসারত্রয়ী রুবেল-তাসকিন-মাশরাফি যেভাবে হামলে পড়লেন ইংলিশদের ওপর, সত্যিই মুগ্ধতাজাগানিয়া। একই সঙ্গে আশাজাগানিয়া! বাংলাদেশের সমর্থকেরা তো এটাই চা-ই, নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড়-নির্ভর নয়, বাংলাদেশ জিতবে একটি দল হয়েই।
বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলের কণ্ঠেও এ কথারই অনুরণন। আইসিসির ওয়েবসাইটে নিজের কলামে লিখেছেন, ‘ব্যাটিংয়ে তামিম বা সাকিবের অবদান ছাড়াও জিততে পারে, বাংলাদেশ তা করে দেখিয়েছে। ’
এমন নয়, দলে সাকিবের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব কমেছে। বরং অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে তা এখন বেশি। কারণ, বাংলাদেশ খেলছে বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট। আর এ বিশ্বকাপ এখনো আসল সাকিবকে দেখেনি। সেই আসল সাকিব ডানা মেললেই নকআউট পর্বে বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রাটা আরও দীর্ঘ হবে। কোয়ার্টার ফাইনাল পেরোলেই সেমিফাইনাল। আর সেমিফাইনাল পেরোলেই তো সেই স্বপ্নের দুয়ার। মাত্র তো তিনটিই ম্যাচ!

No comments

Powered by Blogger.